কৃষিবিদ যখন কৃষক, এক জমিতেই ৮-১০ রকমের ফসল

নোয়াখালী সংবাদাদাতা: ২০২০ সালে নোয়াখালী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে কৃষি বিভাগে পড়ালেখা শেষ করেন। কিন্তু ‘পড়ালেখা শেষ হলেই চাকরি করতে হবে, চাকরি না হলে ব্যর্থ’ এমন ভাবনা পাল্টে দিয়েছেন তিনি। দেখিয়েছেন, অর্জিত জ্ঞানের সঠিক ব্যবহারই শিক্ষার সফলতা। উদ্যোক্তা হয়েও মেধার বহিঃপ্রকাশ ঘটানো সম্ভব। এমনটা প্রমাণ করলেন টাঙ্গাইলের দেলদুয়ার উপজেলার আটিয়া ইউনিয়নের গোমজানি গ্রামের তরুণ কৃষিবিদ শাকিল আহম্মেদ।

তিনি জানান, লকডাউনে শুরু করেন কৃষি জমিতে সবজি ও ফল চাষ। একই জমিতে ৮/১০ প্রকারের ফসল যৌথ চাষ করে কিভাবে পুরো জমিকে কাজে লাগানো যায়, তা শিখিছেন। প্রথমে স্কোয়াশ চাষ করেন। এরপর তার প্রকল্পকে ক্রমশ বৃদ্ধি করছেন। বিষ প্রয়োগ ব্যতিত পোকা দমন, ক্ষতিকারক সার ব্যবহার না করে কম্পোস্ট সারের ব্যবহার, পোকা পালন করে মাছ, মুরগি ও মাছের প্রাকৃতিক খাদ্য তৈরি, মালচিং পদ্ধতিতে চাষাবাদে পানি ও সারের অপব্যবহার রোধ করা, অনলাইনে কৃষকদের ঐক্যবদ্ধ করে পরামর্শের মাধ্যমে আধুনিকীকরণ করে কৃষিকাজে বিশেষ ভূমিকা রেখে অল্প দিনেই প্রশংসিত হচ্ছেন এই তরুণ।

শাকিল একই গ্রামের আব্দুল করিমের ছেলে। দেশের কৃষি ও কৃষক রক্ষায় নিজেই কৃষক হয়ে মাঠে কাজ করছেন। কৃষি ও কৃষকদের আধুনিকরণ করতে নানা উদ্যোগ গ্রহণ করেছেন তিনি। তাকে অনুসরণ ও তার পরামর্শ নিয়ে স্থানীয় কৃষকরা ক্রমশ আধুনিক হচ্ছেন। অধিক লাভবান হচ্ছেন কৃষি কাজে। শাকিলের ধারণা, দেশ ও দেশের মানুষকে বাঁচাতে হলে কৃষিকে বাঁচাতে হবে, দেশের কৃষককে বাঁচাতে হবে। রাষ্ট্রের অন্তিম মুহূর্তে রাষ্ট্র বৈদেশিক খাদ্য রপ্তানি করতে ব্যর্থ হলে তখন দেশের মানুষের খাদ্যের যোগান দেবে কৃষক। সেই কৃষকদের আধুনিক করতে চাকরির পেছনে না ছুটে ছুটছেন কৃষি ও কৃষকদের পেছনে। বিসিএস করে কৃষি কর্মকর্তা হওয়ার স্বপ্ন নেই শাকিলের। স্বপ্ন কৃষকদের আধুনিক করা।

কৃষিবিদ শাকিল আহম্মেদ বলেন, লকডাউনে যখন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ ছিল, তখন পরিবার থেকে অল্প পুঁজি নিয়ে এক টুকরো জমিতে শুরু করি স্কোয়াশ চাষ। আধুনিক চাষাবাদে ফলন হয় পর্যাপ্ত। ফলে প্রথম বছরেই অর্ধ লাখ টাকা লাভ হয়। ২০২১ সালের বন্যায় ডুবে যায় সবজির জমিগুলো। বসে না থেকে পুকুর কিনে মাছের ওপর বিনিয়োগ করি। ফলে অর্থ সংকটে পড়ি। এসময় কিছু বিনিয়োগকারীর সাথে আমার পরিচয় হয়। কিছু প্রফেসরদের সাথেও পরিচয় হয়। ওই সময় ফার্মনেট এশিয়া নামের একটি অনলাইন ভিত্তিক কোম্পানি চালু করি। যার কাজ কৃষক-ভোক্তা ও বিনিয়োগকারীদের আধুনিক উন্নত প্রযুক্তির মাধ্যমে সংযুক্ত রাখা। এখানেও সারা পাই যথেষ্ট।

বর্তমানে স্কোয়াশ ৪২ শতাংশ, ক্যাপসিকাম ৪০ শতাংশ, শসা ৫০ শতাংশ, সমন্বিত মিশ্র ফল ও সবজি চাষ ১২৫ শতাংশ জমিতে চাষাবাদ করছেন। সমন্বিত সবজি চাষের একই জমিতে রয়েছে পেঁপে, টমেটো, শসা, রেড ক্যাবেজ, ব্রোকলি, রক মেলন তরমুজ, পাতাকপি, কদু ও লাল শাক। একটি জমিকে পুরোপুরি ব্যবহার করতে সমন্বিত চাষ শুরু করেন। ২৫৭ শতাংশ জমিতে বিনিয়োগ করেছেন প্রায় ৬ লাখ টাকা। ১০ লাখ টাকা বিক্রির টার্গেট নিয়ে কাজ করছেন তিনি। বর্তমানে তার উৎপাদিত সবজি ও ফল স্থানীয়দের চাহিদা মিটিয়েও রাজধানীতে যাচ্ছে। প্রায় শতাধিক কৃষক শাকিলের পরামর্শ ও সহযোগিতা নিয়ে কৃষিকাজে ব্যাপক সফলতা পাচ্ছেন। স্থানীয় কৃষক বাহাদুর, সেলিম মিয়া, কালাম মিয়া, সোহরাব মাস্টার জানালেন শাকিলের সহযোগিতার কথা।

ব্যতিক্রমী উদ্যোগ:
পানি ও সারের অপচয় রোধে মালচিং পদ্ধতিতে চাষাবাদ বেছে নিয়েছেন শাকিল। মালচিং ফ্লিম পদ্ধতিতে চাষাবাদ করলে সারের অপচয় কম হয়। আগাছা কম হবে। আলো-বাতাস সহজেই প্রবেশ করতে পারবে। পলিথিন দিয়ে ঢেকে থাকায় পানিও কম লাগে। বাইরের পোকার আক্রমণ থেকে শস্যকে রক্ষা করতে প্রতিটি জমিতে ৭ ফিট উচ্চতার নেট দিয়েছেন। এসব পোকা ৭ ফিটের উপর দিয়ে উড়তে পারে না। সেক্স ফেরোমোন ট্র্যাপ স্কিটি ট্যাাপের মাধ্যমে যৌবিক উপায়ে পোকা দমন করছেন। উর্বরতা বাড়াতে প্রাকৃতিক সার, কেঁচো স্যার, ট্রাইকো কম্পোস্ট উৎপাদন ও প্রয়োগ করছেন।
প্রতিটি শস্যের জন্য রেখেছেন বেকআপ প্ল্যান। একই জায়গায় একাধিক বীজ বপন করেন, যাতে একটি বীজ বা চারা নষ্ট হলেও অপরটি থেকে যায়। পোকার আক্রমণের আগাম খবর জানতে আর্টিফিসিয়ালি ইন্টিলিজেন্ট (এআই) প্রযুক্তি নিয়েও কাজ করছেন তিনি। বাড়িতেই ব্লাক সোলজার ফ্লাই পালন করছেন তিনি। যার লাভা মাছ ও মুরগির জন্য উন্নত অর্গান খাবার। সবজির জন্য বাড়িতেই তৈরি করছেন কেঁচো সার।

কৃষক-কৃষি নিয়ে ভবিষ্যত পরিকল্পনা:

কৃষিবিদ হয়েও বিসিএস বা অন্য কোনো চাকরির কথা ভাবছেন না শাকিল। তিনি আজীবন কৃষি ও কৃষকদের নিয়ে কাজ করতে চান। তার ভাবনাগুলোকে ছড়িয়ে দিতে চান। ফার্মনেট এশিয়া কোম্পানির মাধ্যমে কৃষকের জন্য ১০০ জন কৃষিবিদ নিয়োগ দেওয়ার পরিকল্পনা করছেন তিনি। শস্য, ফল, মাছ, সবজি ও পোল্টিসহ পুরো কৃষিকে আধুনিক কৃষির সাথে সমন্বয় করানোই ফার্মনেটের প্রধান লক্ষ্য। সয়েল সেন্সর ডেভেলপ করার ভাবনা রয়েছে তার। ভবিষ্যতে এগ্রো ট্যুরিজম করার ইচ্ছা রয়েছে তার। কৃষির প্রতি টান থাকবে সব শ্রেণির মানুষের। তার ট্যুরিজম সেন্টারে এসে সরাসরি ফল ছিড়বে মানুষ। গাভির দুধ পাবে এখানে। প্রকৃতি উপভোগ করবে।

২০২৪ সালের মধ্যে দেশের এক হাজার কৃষক নিয়ে কাজ করার কথা ভাবছেন। এমনকি ২০০০ মানুষের কর্মসংস্থানের সুযোগ করার ইচ্ছা রয়েছে তার। ইতোমধ্যে চরাঞ্চলের শ্রমিকদের কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করেছেন তিনি। বীজ বপন ও সবজি-ফল তোলার কাজে নারীদের কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করেছেন।

শাকিল আরও বলেন, কৃষি অফিসার হলে একটি নির্দিষ্ট এলাকার কৃষকদের উপকার করতাম। অঞ্চল ভেদে কাজ করার সুযোগ পেতাম। এখন অনলাইনে বিশ্বব্যাপী কাজের সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে। স্বপ্নকে বাস্তবায়ন করতে সরকারি সহযোগিতার প্রয়োজন। ময়মনসিংহ অঞ্চলের নিবিরতা প্রকল্পের আওতায় আধুনিক শেডনেট হাউজ প্রকল্প সহযোগিতা পাওয়ারও আবেদন জানান শাকিল।