১৬ বছর যাবত পর্দানশীন নারীদের নাগরিকত্ব বঞ্চিত করে মানবাধিকার হরণের প্রতিবাদে বিক্ষোভ সমাবেশ ও স্মারকলিপি প্রদান

ঝিনাইদহ প্রতিনিধি:
“গত ১৬ বছর যাবত পর্দানশীন নারীদের নাগরিকত্ব বঞ্চিত করে মানবাধিকার হরণের প্রতিবাদে সংবাদ সম্মেলন” এই শিরোনামে আজ ২৭ জানুয়ারী, ২০২৫ ইং, রোজ- সোমবার, ঝিনাইদহ জেলার পায়রা চত্বরের ‘ঝিনাইদহ মহিলা আনজুমান’ নামক একটি সংগঠন।
‘ঝিনাইদহ মহিলা আনজুমান’ নামক সংগঠনের প্রতিনিধিগণ বলেন, গত ১৬ বছর যাবত ইসির কতিপয় স্বৈরাচারী কর্মকর্তা শুধুমাত্র মুখচ্ছবির অজুহাতে পর্দানশীন নারীদের নাগরিকত্ব আটকে রেখেছে, যা এক প্রকার মানবতাবিরোধী অপরাধ। এতে পর্দানশীন নারীরা মৌলিক ও নাগরিক অধিকার বঞ্চিত হয়ে নিদারুণ কষ্ট করছেন। যে বা যারা গত ১৬ বছর যাবত পর্দানশীন নারীদের মানবাধিকার হরণ করেছে, আমরা তাদের বিচার চাই। ‘ঝিনাইদহ মহিলা আনজুমান’ এর সদস্যরা তাদের ধর্মীয় অধিকার এবং প্রাইভেসীর অধিকার অক্ষুন্ন রেখে এনআইডি’র দাবী জানান।
‘ঝিনাইদহ মহিলা আনজুমান’ এর প্রতিনিধিগণ বলেন, একজন নারী ছবি তুললে ২টি গুনাহ হয়। একটি ছবি তোলার গুনাহ, অন্যটি বেপর্দা হওয়ার গুনাহ। আমরা পর্দানশীন নারীরা সেই গুনাহ থেকে বাঁচতে চাই। ইসি কর্মকর্তারা আমাদের নাগরিকত্ব আটকে রেখে সে গুনাহ করতে বাধ্য করতে পারে না।
‘ঝিনাইদহ মহিলা আনজুমান’ এর প্রতিনিধিগণ আরো বলেন, আমি আমার চেহারা কাউকে দেখাবো না, এটা আমার গোপনীয়তা বা প্রাইভেসীর অধিকার। অর্থাৎ পর্দানশীন নারীদের আজকের এই দাবী শুধু ধর্মীয় অধিকারের মধ্যে পরে না, প্রাইভেসীর অধিকারের মধ্যেও পরে। ফলে দুই দিক থেকেই পর্দানশীন নারীদের দাবী মানবাধিকার ও সংবিধানিক অধিকারের অন্তর্ভূক্ত।
‘ঝিনাইদহ মহিলা আনজুমান’ এর প্রতিনিধিগণ বলেন, এনআইডি ছাড়া পর্দানশীন নারীরা মৌলিক ও নাগরিক অধিকার হারিয়ে মানবেতর জীবন যাপন করছেন। অনেক পর্দানশীন নারী অর্থাভাবে বিনা চিকিৎসায় মারা যাচ্ছেন, কিন্তু এনআইডি ছাড়া ওয়ারিশসূত্রে প্রাপ্ত জমি বিক্রি করতে পারছেন না। অথচ সম্পত্তি বিক্রি করতে পারলে তিনি চিকিৎসার খরচ বহন করতে পারতেন। অনেক পর্দানশীন নারীর দুর্ঘটনায় বাড়িঘর আগুনে পুড়ে গেছে। এনআইডির ছাড়া ত্রাণ নিতে পারছেন না। অনেক বিধবা বা তালাকপ্রাপ্তা পর্দানশীন নারী এনআইডির অভাবে বাসাভাড়া করতে পারছেন না, বাচ্চাদের স্কুলে ভর্তি করাতে পারছেন না। পর্দার সাথে কোন চাকুরী করে জীবন নির্বাহ করতে পারছেন না। গত ১৬ বছর যাবত পর্দানশীন নারীদের সাবেক ইসি কর্মকর্তারা যে কষ্ট দিয়েছে, তা বর্ণনা করে শেষ করা যাবে না।
‘ঝিনাইদহ মহিলা আনজুমান’ এর প্রতিনিধিগণ বলেন, গত জুলাই-আগস্টে ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের মূল লক্ষ্য ছিলো বৈষম্যহীন সমাজ প্রতিষ্ঠা। গত ১৬ বছর শুধুমাত্র পরিপূর্ণ পর্দা করার কারণে নারীদের সাথে যে বৈষম্য হয়েছে, আমরা এ বৈষম্যের পরিসমাপ্তি চাই। অবিলম্বে পর্দানশীন নারীদের ধর্মীয় ও প্রাইভেসীর অধিকার অক্ষুন্ন রেখে এনআইডি প্রদান করা হোক।
‘ঝিনাইদহ মহিলা আনজুমান’ এর প্রতিনিধিগণ বলেন, এনআইডির মুখচ্ছবি পরিবর্তনযোগ্য। এ থেকে প্রমাণিত হয়, মুখচ্ছবি পরিচয় যাচাইয়ের নির্ভরযোগ্য মাধ্যম নয়। অথচ সেই মুখচ্ছবির অজুহাতেই পর্দানশীন নারীদের নাগরিকত্ব বঞ্চিত করা হচ্ছে। এছাড়া ছবি দিয়ে শনাক্তকরণ দুর্নীতিবান্ধব পদ্ধতি, অপরদিকে ফিঙ্গারপ্রিন্ট দিয়ে শনাক্তকরণ দুর্নীতিরোধক পদ্ধতি। যেমন আগে ব্যাংকগুলোতে ছবি দেখে পরিচয় যাচাইয়ে এক ব্যক্তির একাধিক পরিচয়ে ঋণ উত্তোলনের মত প্রতারণার ঘটনা ঘটে। এ প্রতারণা রুখতে বর্তমানে ব্যাংক ঋণ উত্তোলনে ফিঙ্গারপ্রিন্ট যাচাই বাধ্যতামূলক করা হয়েছে। আবার ছবি দেখে পরিচয় যাচাইয়ে একজন ব্যক্তির একাধিক এনআইডি তৈরীর মত ঘটনা ঘটে। এক্ষেত্রে দ্বৈত এনআইডির সমস্যাও দূর হয় ফিঙ্গারপ্রিন্ট যাচাইয়ের মাধ্যমে। আবার একটা সময় বাংলাদেশীদের সাথে চেহারার মিলকে পূজি করে প্রায় আড়াই লক্ষ রোহিঙ্গা বাংলাদেশী পাসপোর্ট ব্যবহার করে বিদেশী পাড়ি জমায়, কিন্তু যখনই তাদের ফিঙ্গারপ্রিন্ট দিয়ে যাচাই শুরু হয়, তখনই রোহিঙ্গাদের প্রতারণা ধরা পড়ে এবং সমস্যার সমাধান হয়। আবার দেখা যায়, অপরাধীরা বার বার রূপ বদলানোয় আইনশৃঙ্খলাবাহিনীর জন্য চেহারার ছবি দেখে অপরাধীকে ধরা কষ্টসাধ্য হয়ে ওঠে। অনেক সময় চেহারার মিল থাকায় নিরাপরাধ ব্যক্তি অপরাধী হিসেবে ধরা পড়ে যায়। এই সমস্যা সমাধানে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী অপরাধী শনাক্তে ফিঙ্গারপ্রিন্ট প্রযুক্তির আশ্রয় নিচ্ছেন। যেমন- এলিট ফোর্স র্যাব ফিঙ্গারপ্রিন্টের OIVS প্রযুক্তি ব্যবহার করছে, পুলিশের সিআইডি ফিঙ্গারপ্রিন্টের AFIS প্রযু্ক্তি ব্যবহার করছেন। অর্থাৎ নির্ভুল যাচাইয়ের জন্য ফিঙ্গারপ্রিন্ট এখন সর্বাধুনিক ও গ্রহণযোগ্য মাধ্যম। উল্লেখ্য কৃত্তিম বুদ্ধিমত্তা বা আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স -এর যুগে ছবির অপব্যবহার অনেকাংশে বৃদ্ধি পেয়েছে। বর্তমানে এক ছবি একাধিক লোক ব্যবহারের প্রযুক্তিও আবিষ্কার হয়েছে। এসব কারণে আধুনিক বিশ্ব মুখচ্ছবি দেখে পরিচয় যাচাই বর্জন করেছে।
‘ঝিনাইদহ মহিলা আনজুমান’ এর প্রতিনিধিগণ বলেন, পর্দানশীন মহিলাদের এনআইডি প্রদানে আইনেও কোন বাধা নেই। বিশেষ করে, পরিচয় নিবন্ধন আইন ২০১০ এবং ২০২৩-এ পরিচয় সনাক্তে চেহারার ছবির কথা উল্লেখ নাই। এমনকি বায়োমেট্রিক যাচাইয়ে ফেসিয়াল রিকগনিশনকেও বাধ্যতামূলক করা হয়নি। কিন্তু তারপরও স্বৈরাচারী মনোভাব থেকেই পর্দানশীন নারীদের নাগরিকত্ব বঞ্চিত করে রেখেছিলো সাবেক ইসি কর্মকর্তারা। পর্দানশীন নারীরা চান, নতুন ইসি কর্মকর্তারা আর সেই পথে না হাটুক। পর্দানশীন নারীদের ধর্মীয় ও প্রাইভেসীর অধিকার অক্ষুন্ন রেখেই অবিলম্বে তাদের এনআইডি প্রদান করুক।
‘ঝিনাইদহ মহিলা আনজুমান’ এর প্রতিনিধিগণ, ঝিনাইদহ জেলার নির্বাচন অফিসারের মাধ্যমে প্রধান নির্বাচন কমিশনার বরাবর স্মারকলিপি প্রদান করেন তিনটি দাবী উত্থাপন করেন-
১. বিগত ১৬ বছর যাবত পর্দানশীন নারীদের মানবাধিকার হরণ করা ইসি কর্মকর্তাদের বিচার করা হোক।
২. পর্দানশীন নারীদের ধর্মীয় ও প্রাইভেসীর অধিকার অক্ষুন্ন রেখেই এনআইডি প্রদান করা হোক।
৩. পর্দানশীন নারীদের ফিঙ্গারপ্রিন্ট নেয়ায় মহিলা অফিস সহকারী বাধ্যতামূলক করা হোক।