সন্ত্রাসবাদের তকমা দিয়ে কাশ্মীরে নির্যাতন বাড়াচ্ছে ভারত
আন্তর্জাতিক : ১৯৯২ সালে একটা ঘটনা চোখে দেখেছিলাম, এক ভারতীয় সেনা এক কাশ্মীরী গর্ভবতী নারীকে রাইফেলের বাট দিয়ে আঘাত করছে আর বলছে, “তোমার পেট থেকে যে সন্তান জন্মাবে, তাকে এখনই খালাস করে দাও”। ওই দৃশ্য আমার মাথায় চিরকালের জন্য গেঁথে গেছে এবং এটা থেকে আমি বুঝতে পেরেছি যে, ওই এলাকায় সম্পূর্ণ দায়মুক্তি দিয়ে যে ভারতীয় সেনাদের মোতায়েন করা হয়েছে, কাশ্মীরীদেরকে তারা কিভাবে দেখে। ভারতের চরম ডানপন্থী এবং হিন্দু জাতীয়তাবাদী এবং তাদের সমর্থকরাও একই যুক্তি দিয়ে চলে, যারা কাশ্মীর অঞ্চলকে বিভক্ত করে কেন্দ্রের সাথে জুড়ে দেয়ার ঘটনা উদযাপন করেছে। তারা এটাকে মুসলিমদের বিরুদ্ধে বিজয় হিসেবে দেখছে, যাদের ভূমি আর নারীদের দখল করার অপেক্ষায় আছে তারা।
অক্টোবর মাসে ভারত সরকারের একজন সিনিয়র দায়িত্বশীল ব্যক্তি কাশ্মীরীদের বহু দশকের স্বাধিকার আন্দোলনকে সন্ত্রাসবাদের সাথে তুলনা করে। ভারতীয় সেনাবাহিনীর প্রধান বিপিন রাওয়াতও কাশ্মীরে কয়েক মাসের যোগাযোগ বন্ধের সিদ্ধান্তকে সমর্থন করে বলেছে, “কাশ্মীর উপত্যকার সন্ত্রাসীদের সাথে পাকিস্তানের নিয়ন্ত্রণকারীদের যোগাযোগ বন্ধ রাখার জন্য এটা করা হয়েছে”। যদিও ভারতের সাবেক একজন জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা সতর্ক করে দিয়ে বলেছে যে, ভারতের জন্য সবচেয়ে বড় হুমকি হলো সামাজিক ও সাম্প্রদায়িক সহিংসতা, পাকিস্তান বা চীন নয়।
৯/১১-এর পর থেকে মুসলিমদেরকে নিয়মিতভাবে অমানবিকীকরণ করা হচ্ছে এবং তাদেরকে অশুভ শক্তি হিসেবে অপপ্রচার চালানো হচ্ছে। সারা বিশ্বেই এবং বিশেষ করে পশ্চিমে মুসলিমদের বিরুদ্ধে প্রাতিষ্ঠানিকভাবে মুসলিম-বিদ্বেষী চিন্তাধারা ছড়ানো হচ্ছে। সন্ত্রাসবাদের ভয় ছড়িয়ে বিভিন্ন দেশের সরকার মুসলিম নাগরিকদের মৌলিক মানবাধিকার কেড়ে নিচ্ছে এবং নাগরিক স্বাধীনতা থেকে বঞ্চিত করছে। আর ছদ্মবেশী ইসলামভীতি বিশেষজ্ঞ প্রতিষ্ঠানগুলো সম্মিলিতভাবে সব মুসলিমের বিরুদ্ধেই অপপ্রচারে নেমে গেছে এবং ইসলামকে তারা বিশ্বজুড়ে ‘সন্ত্রাসের’ উৎস হিসেবে প্রচার করে বেড়াচ্ছে।
কাশ্মীরের মুসলিম তরুণদের প্রতিবাদ নিয়ে আমার নিজের গবেষণায় দেখেছি, কিছু যুবক যদিও নির্যাতনের বিরুদ্ধে লড়াইয়ের জন্য উদ্বুদ্ধ করার ক্ষেত্রে ধর্মকে ব্যবহার করে, কিন্তু এমন কোন উদাহরণ নেই যে, কাশ্মীরের মুক্তি আন্দোলনকে তারা ধর্মীয় আন্দোলন মনে করছে। একইসাথে, তরুণরা এমন ইঙ্গিতও দিয়েছে যে, ভারত সরকার যদি তাদের অহিংস প্রতিবাদকে দমন করা অব্যাহত রাখে, তাহলে কেউ কেউ আবার অস্ত্র হাতে তুলে নিতে পারে। এই বিষয়টি ২০১৬ সালে স্পষ্ট হয়ে গেছে, যখন কিছু তরুণ সশস্ত্র সংগ্রামে ঝুঁকছে বলে সংবাদ প্রকাশিত হয়েছিল।
ভারত সরকারের সম্প্রতি কথিত এক হিসাব করেছে যে কাশ্মীরে প্রায় ২০০ সন্ত্রাসী সক্রিয় রয়েছে। সন্দেহভাজন সন্ত্রাসীর সংখ্যা, যদিও তাদের কথাই ধরা হয় তাহলে এত কম হওয়ার পরও সন্ত্রাসবাদ দমনের নাম দিয়ে সাম্প্রতিককালে বিশ্বের সবচেয়ে সামরিকায়িত এলাকায় আরও সামরিক শক্তি বাড়ানোর সিদ্ধান্তকে বৈধতা দেয়ার চেষ্টা করা হয়েছে। বাস্তবতা হলো সংবিধান থেকে জম্মু ও কাশ্মীরের বিশেষ মর্যাদা বাতিলের একতরফা সিদ্ধান্ত কার্যকরের উদ্দেশ্যে, এবং কাশ্মীরের মুসলমানদের নির্মম ভাবে শেষ করে দেওয়ার জন্যই এই সেনা সমাগম ঘটানো হয়েছে, যেটা এখন সবারই জানা।
বিগত ৩০ বছরে কাশ্মীরে যে প্রাণহানী ও ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে, তার হিসেব করাটা কঠিন। আজ পর্যন্ত প্রায় কয়েক লক্ষ কাশ্মীরীকে হত্যা করা হয়েছে, হাজার হাজার মানুষ নিখোঁজ হয়েছে, হাজার হাজার মানুষ আহত হয়েছে ও অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ হারিয়েছে আর নির্যাতন করা হয়েছে আরও বহু হাজারো মানুষকে। নারী ও শিশুরাও নানারকম, সম্ভ্রমহানী , নির্যাতনসহ বিভিন্ন সহিংসতার শিকার হয়েছে।
ভারত বিশ্বের বিভিন্ন বাণিজ্য অংশীদারদের কাছে এই কথা বিক্রি করতে পেরেছে যে, ‘মুসলিম সন্ত্রাসীদের দমনের জন্য’ তারা এই পদক্ষেপ নিয়েছে। এই বাণিজ্য অংশীদারদের মধ্যে মুসলিম একনায়ক সরকারগুলোও রয়েছে। অর্গানাইজেশান অব ইসলামিক কোঅপারেশান (ওআইসি) যদিও কাশ্মীরের ব্যাপারে উদ্বেগ জানিয়ে দায়সারা বিবৃতি দিয়েছে, কিন্তু সেখানেও মুসলিমদের উপর বর্তমান ভারত সরকারের নির্যাতনের বিষয়টিকে এড়িয়ে যাওয়া হয়েছে। কাশ্মীরে যে মুহূর্তে আট মিলিয়ন মুসলিম অবরুদ্ধ হয়ে আছে, সে সময় সংযুক্ত আরব আমিরাত ভারতের প্রধানমন্ত্রীকে তাদের দেশের সর্বোচ্চ বেসামরিক সম্মাননা দিয়েছে। দুই দেশের মধ্যে দ্বিপাক্ষিক বাণিজ্যের পরিমাণ এখন প্রায় ৫০ বিলিয়ন ডলার। আরেকটি মুসলিম দেশ সৌদি আরবের সাথে ভারতের দ্বিপাক্ষিক বাণিজ্যের পরিমাণ ২৮ বিলিয়ন ডলারে গিয়ে পৌঁছেছে। সৌদি আরবও ২০১৬ সালে ভারতীয় প্রধানমন্ত্রীকে সর্বোচ্চ বেসামরিক সম্মাননা দেয়। আগস্টে কাশ্মীরের স্বায়ত্তশাসন বাতিলের পর সৌদি আরামকো ভারতের তেল ও কেমিক্যাল খাতে ৭৫ বিলিয়ন ডলার বিনিয়োগের ঘোষণা দিয়েছে। আরব আমিরাত ও সৌদি আরব ভারতে মেগা শোধনাগার নির্মাণেরও পরিকল্পনা করছে, যেখানে ৬০ বিলিয়ন ডলার বিনিয়োগ করা হবে।
বিশ্বের তথাকথিত বৃহত্তম গণতান্ত্রিক দেশটি বিশ্বকে এটা এক ধরনের বুঝিয়ে নিয়েছে যে, কাশ্মীরী মুসলিমদের জীবন অপ্রয়োজনীয়। জমি দখল, পরিবেশগত বিপর্যয় এবং বহিরাগতদের বসত গড়ার বিষয়গুলোকে স্বাভাবিক করে ফেলা হচ্ছে। বিভিন্ন দেশের নেতারা তাদের অর্থনৈতিক স্বার্থকে বিবেকের উপরে স্থান দিয়েছেন। তারা হিন্দুত্ববাদের ভয়াবহ হুমকি, হিন্দু জাতীয়তাবাদের কারণে সৃষ্ট সহিংসতা, উগ্রবাদী দল ‘আরএসএস’, বহু মিলিয়ন ভারতীয় মুসলিমের নাগরিকত্ব কেড়ে নেয়া এবং তাদেরকে বন্দিশিবিরে আটকের মতো বিষয়গুলো এড়িয়ে যাচ্ছে।
বিশ্বের ক্ষমতাধরদেরকে অবশ্যই তাদের মনোযোগের কেন্দ্র পরিবর্তন করে সহাবস্থান এবং শান্তিকে প্রাধান্য দিতে হবে এবং মুসলিমদের অশুভ জ্ঞান করা বাদ দিতে হবে। কাশ্মীরে যে গণহত্যা চলছে, সেটা নিয়ে মানবাধিকার সংগঠনগুলো উদ্বেগ জানিয়েছে। কাশ্মীরীদেরকে সন্ত্রাসী আখ্যা দিয়ে তাদেরকে অমানবিক হিসেবে চিত্রিত করলে এই অঞ্চলে অস্থিতিশীলতা বৃদ্ধি ছাড়া কোন লাভ হবে না, যেখানে পারমাণবিক যুদ্ধের আশঙ্কা রয়েছে।