শ্রীলঙ্কায় সাম্প্রদায়িক সিদ্ধান্তে ইসলাম বিদ্বেষী মনোভাব আরো বাড়বে
শ্রীলংকার ক্ষমতাসীন পোদুজানা পেরামুনা (এসএলপিপি) দল সারা দেশে গরু জবাইয়ের উপর পুরোপুরি নিষেধাজ্ঞা আরোপের ইচ্ছার কথা জানিয়েছে। প্রধানমন্ত্রী মাহিন্দা রাজাপাকসা এ ব্যাপারে পার্লামেন্টারি গ্রুপের সমর্থন পেয়েছেন। তবে এটা কার্যকরের জন্য এখনও অপেক্ষা করা হচ্ছে।
শ্রীলংকার ২২ মিলিয়ন জনসংখ্যার মধ্যে রয়েছে বৌদ্ধ (৭০.২%), হিন্দু (১২.৬%), মুসলিম (৯.৭%), এবং ক্যাথলিক খ্রিস্টান (৬.১%)।
শ্রীলংকানরা মোটের উপর গোশত খেয়ে থাকে। গরুর গোশত মুসলিম আর খ্রিস্টানদের প্রায় নিয়মিত খাবার।
বছর প্রতি মাথাপিছু গরুর গোশতেরর লভ্যতা দ্বিতীয় সর্বোচ্চ পর্যায়ে (১.৮ কেজি)। এর বেশ আগে রয়েছে মুরগির গোশত (৭.৯ কেজি)। কিন্তু খাশির গোশত (০.১ কেজি)।
গরু জবাই নিষিদ্ধে নতুন প্রস্তাবের পেছনের কারণ
সম্প্রতি রাজাপাকসা ভাইয়েরা শ্রীলংকার ক্ষমতায় তাদের অবস্থান পাকাপোক্ত করেছে।
গোতাবায়া রাজাপাকসা ২০১৯ সালের নভেম্বরে প্রেসিডেন্ট হয়। ২০২০ সালের আগস্টে পার্লামেন্টে নির্বাচনে বড় ব্যবধানে জয়ী হওয়ার পর মাহিন্দা রাজাপাকসা নতুন করে আবার প্রধানমন্ত্রী হয়েছে।
বাইরে থেকে দেখলে রাজাপাকসা ভাইদের এখন কাউকে তুষ্ট করার দরকার নেই। সিংহল বৌদ্ধ বা হিন্দু সংখ্যালঘু কাউকেই তুষ্ট করার জন্য এই পদক্ষেপের দরকার ছিল না। আর মুসলিম আর খ্রিস্টানদের প্রভাব রাজনৈতিকভাবে খুব একটা গুরুত্বপূর্ণ নয়।
তবে ক্ষমতা গ্রহণের এক মাসেরও কম সময়ের মধ্যে এ সিদ্ধান্ত নেয়ার পেছনে ব্যাখ্যা থাকতে পারে।
এই ঘোষণার অর্থ এটাও হতে পারে যে, সরকার তাদেরকে আশ্বস্ত করছে যে, তাদের সাম্প্রদায়িক দাবি সরকারের অগ্রাধিকারের জায়গায় রয়েছে।
সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলো, সংবিধানের ২০তম সংশোধনী প্রস্তাব করা হয়েছে এবং এটা বাস্তবায়নের প্রক্রিয়ায় সিংহলী বৌদ্ধদের সাম্প্রদায়িক সমর্থন সঙ্গে রাখা। এই সংশোধনীর মাধ্যমে ১৯তম সংশোধনী বাতিল বা পরিমার্জনা করা হবে, যেটা আগের সরকার কার্যকর করেছিল।
আর এখানে বারতি সুবিধা হিসেবে শ্রীলংকার নেতারা শ্রীলংকার উগ্রবাদী হিন্দুদের সমর্থনও পেয়ে যাবে সরকার।
এরপর কি?
যদি তাদের সাম্প্রদায়িক সিদ্ধান্ত হিসেবে গরু জবাই নিষিদ্ধ করা হয়, তাহলে এটা জাতীয়তাবাদী সিংহল বৌদ্ধ এবং মুসলিমদের মধ্যে বিভাজন আরও বাড়াবে। শ্রীলংকায় জাতিগত সঙ্ঘাতের দীর্ঘ ইতিহাস রয়েছে।
যদিও আন্তর্জাতিক মনোযোগ হলো তামিল গেরিলা আর শ্রীলংকা সরকারের মধ্যে সঙ্ঘটিত দীর্ঘ যুদ্ধ। তবে সেখানে বৌদ্ধ আর মুসলিমদের মধ্যেও বেশ অনেকবার সঙ্ঘর্ষ হয়েছে।
শ্রীলংকায় যে ইসলামবিদ্বেষ রয়েছে, সেটা বোঝা যায়। বৌদ্ধরা ইসলাম রীতি নীতি ও সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য, যেমন বোরকা পরার মতো বিষয়গুলো নিয়ে এবং হালাল গোশত খাওয়ার বিষয়গুলো নিয়ে নেতিবাচক মন্তব্য করে আসছে। বৌদ্ধরা দাবি করে থাকে যে, হালাল গোশত পাওয়ার প্রক্রিয়াটা যন্ত্রণাদায়ক এবং সেটা বৌদ্ধ বিশ্বাসের বিরোধী।
আস্থার যে ঘাটতি ছিল, ২০১৯ সালের এপ্রিলে কলম্বোতে বিভিন্ন বিলাসবহুল হোটেলে হামলার পর সেটার মাত্রা আরও বেড়ে যায়। স্থানীয়রা সন্ত্রাসীদের আশ্রয় দিয়েছিল বলে ধারণা করা হয়। ওই হামলায় কয়েকশ মানুষ মারা যায়।
মুসলিমবিদ্বেষী মনোভাবের কারণে হামলার পরের মাসগুলোতে বৌদ্ধ-মুসলিমদের মধ্যে সঙ্ঘর্ষ হয়েছে। সারা বিশ্বের মানবাধিকার সংগঠনগুলো শ্রীলংকায় মুসলিমদের বিরুদ্ধে তাদের তথাকথিত মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনার কথা বলেছে।
এই নিষিদ্ধের সিদ্ধান্তের অর্থনৈতিক দিকও রয়েছে। গরুর গোশত আমদানি করতে গিয়ে টানাপড়েনের বিদেশী মুদ্রার রিজার্ভের উপর আরও চাপ পড়বে। তাছাড়া ভোক্তাদের ক্রয়ক্ষমতার উপরও এর চাপ পড়বে। এতে অনেকে তাদের কর্মসংস্থানও হারাবে। গরুর গোশত খাওয়া বন্ধ করলে অর্থনীতির উপর চরম চাপ পরবে।
মাহির খৈয়াম
গবেষক ও লেখক