রমজানের সুধা, ত্রিশ দিনের আত্মশুদ্ধির সোনালি প্রহর

লেখক জাহেদুল ইসলাম আল রাইয়ান
রমজান, ইসলাম ধর্মের পবিত্রতম মাস, মানবতার জন্য আল্লাহর পক্ষ থেকে এক অনন্য উপহার। এই মাসে মুমিন হৃদয়ে নামে আত্মশুদ্ধির স্নিগ্ধ বারিধারা। রমজানের প্রতিটি দিন, প্রতিটি মুহূর্ত আল্লাহর নৈকট্য লাভের সুবর্ণ সুযোগ এনে দেয়। এ মাসেই নাজিল হয়েছিল পবিত্র কোরআন, যা মানব জাতির জন্য পথপ্রদর্শক এবং সত্য-মিথ্যার পার্থক্যকারী। আল্লাহ্ বলেন,
“রমজান মাস, যাতে কোরআন নাজিল করা হয়েছে, মানুষের জন্য পথপ্রদর্শক এবং সঠিক পথের ও সত্য-মিথ্যার পার্থক্যকারীরূপে।” (সূরা আল-বাকারা, আয়াত: ১৮৫)
রমজান মাসকে তিন ভাগে ভাগ করা হয়েছে, প্রথম দশক রহমতের, দ্বিতীয় দশক মাগফিরাতের এবং শেষ দশক নাজাতের।
রাসূলুল্লাহ্ সা. বলেন,
“এটা এমন এক মাস, যার প্রথম অংশে রয়েছে রহমত, মধ্যবর্তী অংশে মাগফিরাত (ক্ষমা) এবং শেষ অংশে জাহান্নাম থেকে নাজাত (মুক্তি)।” (ইবনে খুজাইমা, হাদিস: ১৮৮৭)
রমজানের প্রথম দশক শুরু হয় সাহরি খাওয়ার মাধ্যমে। সাহরি খাওয়া বরকতময়, রাসূল সা. বলেছেন,
“সাহরি খাও, কারণ সাহরিতে বরকত রয়েছে।” (সহিহ মুসলিম, হাদিস: ১০৯৫)
এ সময় রোজাদার নিজেকে পবিত্র রাখে, পাপ কাজ থেকে বিরত থাকে। মিথ্যা কথা, গীবত, অহংকার, হিংসা, বিদ্বেষ—এসব থেকে নিজেকে দূরে রাখার চেষ্টা করে। আল্লাহর রহমত বর্ষিত হয় সে ব্যক্তির উপর, যে নিজের জিহ্বা, চোখ, কান, মন সবকিছুর রোজা রাখে।
রমজানের দ্বিতীয় দশক হলো মাগফিরাতের সময়। এ সময়ে বান্দা আল্লাহর কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করে, তওবা করে, কৃত গুনাহের জন্য কান্নায় ভিজিয়ে দেয় সেজদার মাটি।
আল্লাহ বলেন,
“হে আমার বান্দারা, যারা নিজেদের প্রতি জুলুম করেছো! তোমরা আল্লাহর রহমত থেকে নিরাশ হয়ো না। নিশ্চয়ই আল্লাহ সকল গুনাহ মাফ করেন।” (সূরা আজ-জুমার, আয়াত: ৫৩)
এই দশকে ইবাদতে মনোযোগী হওয়া, কোরআন তিলাওয়াত, তাহাজ্জুদ নামাজ, ইস্তেগফার পড়া অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। আল্লাহর কাছে নিজেদের ত্রুটি-বিচ্যুতি মাফ চাওয়া এবং পরিশুদ্ধ জীবনের প্রতিজ্ঞা গ্রহণ করা—এটাই এই দশকের মূল বার্তা।
রমজানের শেষ দশক হলো জাহান্নাম থেকে মুক্তির সময়। এই সময়ে রয়েছে লাইলাতুল কদর, যা হাজার মাসের চেয়েও বরকতময়।
আল্লাহ বলেন,
“লাইলাতুল কদর হাজার মাসের চেয়েও উত্তম।” (সূরা আল-কদর, আয়াত: ৩)
এই রাতের ইবাদত বান্দার ভাগ্য বদলে দিতে পারে, জীবনের সমস্ত পাপ মাফ করিয়ে দিতে পারে।
রাসূল সা. এ রাতে বিশেষ দোয়া পড়তে বলেছেন,
“আল্লাহুম্মা ইন্নাকা আফুউন, তুহিব্বুল আফওয়া, ফাআফু আন্নি।”
অর্থ: হে আল্লাহ! তুমি ক্ষমাশীল, তুমি ক্ষমা করতে ভালোবাসো, তাই আমাকে ক্ষমা করো।
এ সময় ইতিকাফ করা অত্যন্ত ফজিলতপূর্ণ। ইতিকাফকারীরা মসজিদে অবস্থান করেন, দুনিয়াবি কাজ থেকে নিজেদের আলাদা করে একান্তে আল্লাহর ইবাদতে মগ্ন থাকেন।
রমজান মাসে শুধুই রোজা রাখা নয়, বরং প্রতিটি ইবাদতে মুমিনকে মনোযোগী হতে হয়। প্রতিদিন পাঁচ ওয়াক্ত নামাজের সাথে তারাবিহ নামাজ পড়া, কোরআন তিলাওয়াত, আল্লাহর জিকির, দান-সদকা, দোয়া এবং ইস্তেগফার অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
রাসূল সা. বলেছেন
“যে ব্যক্তি ঈমান এবং সওয়াবের আশায় রমজানের রোজা পালন করবে, তার পূর্ববর্তী সমস্ত গুনাহ মাফ করে দেওয়া হবে।” (সহিহ বুখারি, হাদিস: ১৯০১)
রমজানে দান-সদকা এবং যাকাত আদায়ের ফজিলতও অপরিসীম। দান করা, অভাবীদের সহায়তা করা এবং যাকাত আদায়ের মাধ্যমে সমাজে সমতা প্রতিষ্ঠা করা হয়।
ইফতারের সময় রোজাদারদের জন্য এক অনন্য তৃপ্তির সময়।
রাসূল সা. ইফতারের আগে এই দোয়া পড়তেন,
“আল্লাহুম্মা ইন্নি লাকা সুমতু ওয়া বিকা আমান্তু ওয়া আলাইকা তাওয়াক্কালতু ওয়া আলা রিজকিকা আফতারতু।”
অর্থ: হে আল্লাহ! আমি তোমার জন্য রোজা রেখেছি, তোমার উপর ঈমান এনেছি, তোমার উপর ভরসা করেছি এবং তোমারই রিজিকে ইফতার করছি।
রমজান আমাদের শিখিয়ে দেয় সংযম, ধৈর্য, সহনশীলতা এবং আল্লাহর উপর পূর্ণ আস্থা রাখা। এই মাসে নিয়মিত ইবাদত-বন্দেগি আমাদের আত্মাকে পরিশুদ্ধ করে, পাপমুক্ত জীবনের পথে ধাবিত করে এবং আল্লাহর সন্তুষ্টি লাভে সহায়ক হয়। আল্লাহ্ আমাদের সবাইকে রমজানের পূর্ণ ফজিলত অর্জনের তৌফিক দান করুন এবং আমাদের গুনাহগুলো মাফ করে দিন।!আমিন!!
লেখক,শিক্ষার্থী, আল আজহার বিশ্ববিদ্যালয়, কায়রো, মিশর