বাংলাদেশ কী পেল
প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির নেতৃত্বাধীন বিজেপি সরকার ক্ষমতায় আসার পর প্রথমবারের মতো ঢাকা সফর করলেন ভারতের অর্থ ও করপোরেটবিষয়ক মন্ত্রী অরুণ জেটলি। পেশায় আইনজীবী হলেও দীর্ঘ রাজনৈতিক জীবনের অধিকারী অরুণ জেটলি এখন বিজেপি সরকারের শীর্ষ তিন ক্ষমতাধর ব্যক্তির একজন।
তিন দিনের সফর শেষ করে গতকাল দুপুরে নয়াদিল্লি ফিরে গেছেন অরুণ জেটলি। তার এই সফরে বাংলাদেশকে ৩৬ হাজার কোটি টাকা ঋণ দেওয়ার চুক্তি করেছে বাংলাদেশ। মার্চে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নয়াদিল্লি সফরে প্রতিশ্রুত এই ঋণ আর্থিক হিসেবে কোনো দেশকে ভারতের দেওয়া সর্বোচ্চ ঋণ। ভারতের গুরুত্বপূর্ণ এই মন্ত্রীর সফরে শুধু কি ঋণ চুক্তিই হলো? এর বাইরে বাংলাদেশের লাভ-ক্ষতির পাল্লায় কতটা হাওয়া লাগল জানতে চাইলে ঢাকার এক শীর্ষ কূটনীতিক জানান, হেভিওয়েট রাজনীতিকদের সফর বিনিময়ে বস্তুগত প্রাপ্তির চেয়ে একে অপরের ভাবের আদান প্রদানটাই বেশি গুরুত্বপূর্ণ। ভারতের অর্থমন্ত্রী সরাসরি বাংলাদেশের ব্যবসায়ীদের বিভিন্ন সুবিধা-অসুবিধা ও আকাঙ্ক্ষার কথা জেনে গেলেন। এগুলো পরবর্তীতে নীতি প্রণয়নের ক্ষেত্রে বড় ধরনের ভূমিকা রাখে। এ ছাড়া অরুণ জেটলি বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্কের ক্ষেত্রেও স্পষ্ট বার্তা দিয়ে গেছেন বলে জানান এই কূটনীতিক।
জানা যায়, বাংলাদেশের অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিতের আমন্ত্রণে গত ২ থেকে ৪ জুলাই অরুণ জেটলির ঢাকা সফরের সূচি এক দফায় স্থগিত হয়। সেই আমন্ত্রণেই মঙ্গলবার দুপুরে ঢাকা এসে পৌঁছান ভারতীয় অর্থমন্ত্রী। প্রথম দিনেই বাংলাদেশ ও ভারতের ব্যবসায়ীদের সঙ্গে মতবিনিময় করেন অরুণ জেটলি। পরদিন বুধবার অর্থ মন্ত্রণালয়ে অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত ও ভারতের অর্থমন্ত্রীর উপস্থিতিতে বাংলাদেশের অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগের সচিব কাজী শফিকুল আযম ও ভারতের রাষ্ট্রায়ত্ত এক্সপোর্ট-ইমপোর্ট ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ডেভিড রাসকুইনা আরও ৪৫০ কোটি ডলার বা সাড়ে ৪ বিলিয়ন ডলার ঋণ চুক্তি স্বাক্ষর করেন। এ অর্থ দিয়ে বাংলাদেশের বিদ্যুৎ, রেলপথ, সড়ক, জাহাজ চলাচল ও বন্দর, শিক্ষা, স্বাস্থ্য ও আর্থসামাজিক উন্নয়নের ক্ষেত্রে ১৭টি প্রকল্প বাস্তবায়ন হবে। মাত্র ১ শতাংশ হার সুদে এ ঋণ পাঁচ বছরের গ্রেস পিরিয়ডসহ ২০ বছর সময়কালে পরিশোধ করা যাবে। ২০ বছরের মধ্যে ফেরত ছাড়াও ভারত থেকে ঠিকাদার নিয়োগ ও নির্মাণসামগ্রীর একটি উল্লেখযোগ্য অংশ দেশটি থেকে ক্রয়সহ আগের চুক্তির মতো অন্যান্য শর্ত বহাল থাকবে। এর আগে বাংলাদেশকে দুই দফায় আরও ৩০০ কোটি ডলার ঋণ দেয় ভারত। তিন দফায় ভারত মোট সাড়ে ৭০০ কোটি ডলার ঋণ দিচ্ছে। বাংলাদেশি মুদ্রায় যা ৬০ হাজার কোটি টাকা। চুক্তি স্বাক্ষর করে অরুণ জেটলি বলেন, ভারত-বাংলাদেশ দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ক ইতিহাসের সর্বোচ্চ পর্যায়ে পৌঁছেছে। অন্যান্য দেশের জন্য এটি একটি মডেল বলে উল্লেখ করেন তিনি। সফরে আরও একটি চুক্তি সই হয়। এটি হলো— বাংলাদেশের অভ্যন্তরে ভারতীয় বিনিয়োগ সুরক্ষায় ‘প্রোটেকশন অ্যান্ড প্রমোশন অব ইন্ডিয়ান ইনভেস্টমেন্ট’ সংক্রান্ত। বাংলাদেশ সরকারের পক্ষে শিল্প সচিব মোহাম্মদ আবদুল্লাহ ও ভারতের অর্থনৈতিক বিষয়ক সচিব সুভাষ চন্দ্র গার্ক চুক্তিতে সই করেন। গত ২০১০ সালে করা এ সংক্রান্ত চুক্তির মেয়াদ চলতি বছরই শেষ হচ্ছে। দুই দেশের মধ্যে বাণিজ্য-বিনিয়োগ বাড়াতে বিদ্যমান চুক্তিটি ভবিষ্যতেও বহাল রাখার লক্ষ্যে এ চুক্তি সই হয়। আশা করা হচ্ছে এই চুক্তির ফলে দুই দেশের উন্নয়ন অংশীদারিত্ব আরও গতিশীল হবে।
ঢাকা ও দিল্লির কূটনীতিক ও অর্থনীতিবিদরা বলছেন, অরুণ জেটলি ঢাকায় ভারতের অর্থনৈতিক গতিধারার বর্ণনা করেছেন। ভারত আগামীতে কোন অবস্থানে যাওয়ার লক্ষ্যে অর্থনীতি পরিচালনা করছে তা প্রতিবেশী হিসেবে বাংলাদেশের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এ ছাড়া অরুণ জেটলি নিজেই বলেছেন দক্ষিণ এশিয়ায় শুধু ভারত ও বাংলাদেশই অভ্যন্তরীণ উন্নয়নের মাধ্যমে বিশ্বের দৃষ্টি কাড়তে সক্ষম হয়েছে। অরুণ জেটলি জানিয়ে গেছেন, ভারতের স্বার্থেই একটি শক্তিশালী, স্থিতিশীল ও সমৃদ্ধ বাংলাদেশ প্রয়োজন। পারস্পরিক সংযোগ জোরদার করতেই বাংলাদেশের সঙ্গে কাজ করতে ভারত প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। দ্বিপক্ষীয় উন্নয়ন অংশীদারিত্ব, উপ-আঞ্চলিক অর্থনৈতিক সহযোগিতা ও এতদাঞ্চলের অর্থনৈতিক সমৃদ্ধির ক্ষেত্রে অন্য সবার মতো যোগাযোগকে ভারতও সর্বোচ্চ গুরুত্ব দেয় বলে জানিয়েছেন ভারতীয় মন্ত্রী। ১৯৬৫ সালের আগে এই অঞ্চলের সড়ক, রেল, জল ও উপকূলীয় জাহাজ চলাচলের যে ব্যবস্থা ছিল তা পুনরুদ্ধারই এখন প্রধান লক্ষ্য। বিশ্লেষকরা বলছেন, এই সফরে অরুণ জেটলিকে বাংলাদেশের অর্থমন্ত্রী সরাসরিই বলেছেন, এলওসির আওতায় নেওয়া প্রকল্পের বাস্তবায়ন সন্তোষজনক নয়। অর্থছাড়ে বিলম্বের পাশাপাশি ব্যবস্থাপনা দুর্বলতাও এজন্য দায়ী। এর প্রতিউত্তরও দিয়েছেন ভারতের মন্ত্রী। জানিয়েছেন, জমি অধিগ্রহণ ও প্রকল্প যাচাইয়ের দুর্বলতাই মূলত বিলম্বের কারণ। তবে এটা শুধু বাংলাদেশে নয়, সব দেশেই হয়। এর আগের দিন বাণিজ্যমন্ত্রী তোফায়েল আহমেদ নন-ট্যারিফ বাধার কথা সরাসরি জানিয়েছিলেন অরুণ জেটলিকে।
যদিও ভারতের ঋণের বিষয়ে বাংলাদেশের অর্থনীতিবিদদের মিশ্র প্রতিক্রিয়া আছে। তারা মনে করেন, এই ঋণের যথাযথ এবং সময়োপযোগী ব্যবহার নিশ্চিত করতে হবে। প্রথম, দ্বিতীয় এলওসির প্রসঙ্গ টেনে তারা বলেন, এই ঋণের অর্থ ছাড়ে এবং প্রকল্প বাস্তবায়নে ধীরগতি রয়েছে। ঋণের অর্থ ছাড় ও প্রকল্প বাস্তবায়নে সক্ষমতা অর্জন করতে হবে। এ বিষয়ে উভয় সরকারকে উদ্যোগী হতে হবে। সাবেক অর্থ উপদেষ্টা ড. এবি মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম বলেন, আপাতদৃষ্টিতে মনে হচ্ছে সুদহার কম। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে ভারতীয় ঋণ নিয়ে প্রকল্প বাস্তবায়ন করলে খরচ বেশি হবে। কারণ প্রকল্প বাস্তবায়নে শতকরা ৭৫ ভাগ প্রয়োজনীয় কাঁচামালসহ অন্যান্য জিনিসপত্র ও সেবা ক্রয় করতে হবে ভারত থেকে। এ ছাড়া ঠিকাদার নিয়োগে প্রতিযোগিতার সুযোগ থাকবে না। এসব নিয়ম মেনে প্রকল্প বাস্তবায়ন করলে খরচ বেশি হবে।
অন্যদিকে, বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠানের সাবেক ঊর্ধ্বতন পরিচালক ড. জায়েদ বখত ঋণ গ্রহণের বিষয়টি ইতিবাচক হিসেবে দেখছেন। তিনি মনে করেন, দুই দেশের মধ্যে এখন ভালো সম্পর্ক রয়েছে। কাজেই এ ঋণ নিয়ে অবকাঠামো উন্নয়নে বিনিয়োগ করলে বাংলাদেশ উপকৃত হবে। পাশাপাশি বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠান (বিআইডিএস)-এর মহাপরিচালক ড. খান আহমেদ সৈয়দ মুরশিদ ভারতীয় ব্যবসায়ীদের সঙ্গে আলাপচারিতার প্রসঙ্গ উল্লেখ করে একটি বেসরকারি টেলিভিশনকে জানিয়েছেন, নানান কারণে ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলে বিনিয়োগের ক্ষেত্রে ভারতীয় ব্যবসায়ীরা অনাগ্রহী। কিন্তু সেখানে থাকা বিশাল জনগোষ্ঠীর জন্য বাংলাদেশকে ব্যবসায়িক হাব বানাতে আগ্রহী ভারতের বিনিয়োগকারীরা। তারা বাংলাদেশে বিনিয়োগ করে পণ্য ওই সব অঞ্চলে সরবরাহে আগ্রহী। এটা সম্ভব হলে বাংলাদেশে বেসরকারি পর্যায়ে মেগা বিনিয়োগ হতে পারে বলে মনে করেন এই অর্থনীতিবিদ। এই আগ্রহের প্রতিধ্বনি পাওয়া গেছে ভারতের ব্যবসায়ীদের শীর্ষ সংগঠন ফেডারেশন অব ইন্ডিয়ান চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির (এফআইসিসিআই) সভাপতি পংকজ পাটেলের কণ্ঠে। তিনি জানিয়েছেন, ভারতীয় ব্যবসায়ীরা বাংলাদেশে বিনিয়োগের সব সম্ভাবনা খতিয়ে দেখছে। দুই দেশই ইতিমধ্যে যোগাযোগ অবকাঠামো উন্নয়নে মনোযোগী হয়েছে। নতুন রেললাইন, নতুন সড়ক ও উপকূল দিয়ে স্থানীয় জাহাজের মতো বাণিজ্য শুরু হয়েছে। এসব বিনিয়োগে বিশেষ ভূমিকা রাখবে।