চেহারা নয়, ফিঙ্গারপ্রিন্ট দিয়ে পরিচয় যাচাই চান পর্দানশীন নারীরা

নিজস্ব প্রতিবেদন:

চেহারার সাথে ছবি মিলিয়ে পরিচয় যাচাই নয়, ফিঙ্গারপ্রিন্ট দিয়ে পরিচয় যাচাইয়ের দাবীতে সমাবেশ করেছে চাঁপাই নবাবগঞ্জ জেলা পর্দানশীন নারী সমাজ নামক একটি সংগঠন। আজ…২৯/০১/২৫ রোজ-বুধবার চাঁপাই নবাবগঞ্জ জেলার নির্বাচন কমিশন অফিস এর সামনে এ সমাবেশের আয়োজন হয়। সমাবেশে পর্দানশীন নারীরা বলেন, শুধুমাত্র পরিপূর্ণ পর্দা করার কারণে পর্দানশীন নারীরা বৈষম্যের শিকার। গত ১৬ বছর যাবত অসংখ্য পর্দানশীন নারীর নাগরিকত্ব আটকে রাখা হয়েছে। শিক্ষাক্ষেত্রেও করা হচ্ছে বঞ্চিত। পরিচয় যাচাইয়ে জোর করে বেগানা পুরুষের সামনে চেহারা খুলতে বাধ্য করা হচ্ছে। পর্দনাশীন নারীরা এসব হেনস্তার অবসান চান। চেহারার বদলে তারা ফিঙ্গারপ্রিন্ট দিয়ে পরিচয় যাচাইয়ের দাবী তুলেন।

 

পর্দানশীন নারীরা বলেন, গত ১৬ বছর যাবত জাতীয় নির্বাচন কমিশনের সাবেক কতিপয় স্বৈরাচারী কর্মকর্তা শুধুমাত্র মুখচ্ছবি না তোলার অজুহাতে পর্দানশীন নারীদের নাগরিকত্ব আটকে রেখেছে। এতে পর্দানশীন নারীরা মৌলিক ও নাগরিক অধিকার বঞ্চিত হয়ে নিদারুণ কষ্টে পতিত হয়েছেন। অনেক পর্দানশীন নারী অর্থাভাবে বিনা চিকিৎসায় মারা যাচ্ছেন, কিন্তু এনআইডি ছাড়া ওয়ারিশসূত্রে প্রাপ্ত জমি বিক্রি করতে পারছেন না। অথচ সম্পত্তি বিক্রি করতে পারলে তিনি চিকিৎসার খরচ বহন করতে পারতেন। অনেক পর্দানশীন নারীর বাড়িঘর দুর্ঘটনায় আগুনে পুড়ে গেছে, কিন্তু এনআইডির ছাড়া ত্রাণ নিতে পারছেন না। অনেক বিধবা বা তালাকপ্রাপ্তা পর্দানশীন নারী এনআইডির অভাবে বাসাভাড়া নিতে পারছেন না, বাচ্চাদের স্কুলে ভর্তি করতে পারছেন না। পর্দার সাথে কোন চাকুরী করে জীবন নির্বাহ করতে পারছেন না। গত ১৬ বছর যাবত জাতীয় নির্বাচন কমিশনের সাবেক কতিপয় স্বৈরাচারী কর্মকর্তা পর্দানশীন নারীদের যে কষ্ট দিয়েছে, তা বর্ণনা করে শেষ করা যাবে না।

পর্দানশীন নারীরা বলেন, শিক্ষা একটি মৌলিক অধিকার। মুখচ্ছবির অজুহাত দিয়ে পর্দানশীন নারীদের এই অধিকার থেকেও বঞ্চিত করা হচ্ছে। “পর্দানশীন নারীরা বেপর্দা হলে শিক্ষা পাবে, নয়ত পাবে না”- এমন অবস্থার সৃষ্টি করা হয়েছে। যেমন- শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে পরীক্ষার হলে পরিচয় যাচাইয়ের জন্য চেহারা ও ছবি মেলানো মত সেকেলে পদ্ধতি ব্যবহার করা হয় । এক্ষেত্রে একজন পর্দানশীন নারীর চেহারার ছবি বেগানা পুরুষ বারংবার দেখে বেপর্দার ঘটনা ঘটছে। আবার অনেক ক্ষেত্রে পুরুষ শিক্ষক ও পুরুষ স্টাফ দিয়ে সেই পর্দানশীন নারীর চেহারা ও ছবি মেলানো হচ্ছে। পর্দানশীন নারীকে বলা হচ্ছে, “তোমার চেহারা না দেখালে তোমাকে চিনবো কিভাবে?” অথচ চেহারা দেখানো ছাড়াও পরিচয় যাচাইয়ের আরো অনেক আধুনিক ও নির্ভুল পদ্ধতি রয়েছে।

 

পর্দানশীন নারীদের প্রতিনিধিগণ বলেন, একজন নারী ছবি তুললে ২টি গুনাহ হয়। একটি ছবি তোলার গুনাহ, অন্যটি বেপর্দা হওয়ার গুনাহ। আবার ঐ ছবিটি পরবর্তীতে যতজন বেগানা পুরুষ দেখবে বেপর্দা হওয়ার গুনাহ তত বাড়তেই থাকবে। এমনকি মৃত্যুর পরও ঐ ছবির কারণে বেপর্দার গুনাহ জারী থাকবে। পর্দানশীন নারীরা সেই গুনাহ থেকে বাঁচতে চান। কিন্তু বর্তমানে রাষ্ট্রে মৌলিক অধিকার আটকে রেখে পর্দানশীন নারীদের গুনাহ করতে বাধ্য করা হচ্ছে, যা তার ধর্মীয় বা দ্বীনি অধিকার লঙ্ঘন।আবার একজন পর্দানশীন নারী তার চেহারা কাউকে দেখাতে চান না, এটা তার গোপনীয়তা বা প্রাইভেসীর অধিকার। ফলে জোর করে চেহারা দেখাতে বাধ্য করা তার গোপনীয়তা বা প্রাইভেসির অধিকার লঙ্ঘন। অর্থাৎ পর্দানশীন নারীদের পরিপূর্ণ পর্দা মেনে মৌলিক অধিকার প্রাপ্তির দাবী শুধু দ্বীনি অধিকারের মধ্যে পরে না, প্রাইভেসীর অধিকারের মধ্যেও পরে। তাই দুই দিক থেকেই পর্দানশীন নারীদের এ দাবী মানবাধিকার ও সাংবিধানিক অধিকারের অন্তর্ভূক্ত।

পর্দানশীন নারীরা বলেন, গত জুলাই-আগস্টে ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের মূল লক্ষ্য ছিলো বৈষম্যহীন সমাজ প্রতিষ্ঠা। গত ১৬ বছর শুধুমাত্র পরিপূর্ণ পর্দা করার কারণে নারীদের সাথে যে বৈষম্য হয়েছে, আমরা এ বৈষম্যের পরিসমাপ্তি চাই। অবিলম্বে পর্দানশীন নারীদের দ্বীনি অধিকার ও প্রাইভেসীর অধিকার অক্ষুন্ন রেখে এনআইডি প্রদান করা হোক। পাশাপাশি শিক্ষাক্ষেত্রেও পর্দানশীন নারীদের দ্বীনি ও প্রাইভেসীর অধিকার অক্ষুন্ন রেখে পরিচয় যাচাইয়ের ব্যবস্থা করা হোক।

 

পর্দানশীন নারীরা বলেন, মানুষের মুখের ছবি পরিবর্তনশীল। সময়ের ও অবস্থার সাথে মানুষের চেহারার দৃশ্য পরিবর্তন হয়। এ থেকে প্রমাণিত হয়, মুখচ্ছবি পরিচয় যাচাইয়ের নির্ভরযোগ্য মাধ্যম নয়। অথচ সেই মুখচ্ছবির অজুহাতেই পর্দানশীন নারীদের নাগরিকত্ব বঞ্চিত করা হচ্ছে, শিক্ষাক্ষেত্রেও করা হচ্ছে বেপর্দা। এছাড়া ছবি ও চেহারা মিলিয়ে সনাক্তকরণ একটি দুর্নীতিবান্ধব পদ্ধতি, অপরদিকে ফিঙ্গারপ্রিন্ট দিয়ে সনাক্তকরণ দুর্নীতিরোধক পদ্ধতি। যেমন- আগে ব্যাংকগুলোতে ছবি ও চেহারা মিলিয়ে পরিচয় যাচাই হতো, তখন চেহারা পাল্টে এক ব্যক্তির একাধিক পরিচয়ে ঋণ উত্তোলন মত প্রতারণার ঘটনা ঘটে। এ প্রতারণা রুখতে বর্তমানে ব্যাংকগুলোতে ঋণ উত্তোলনে ফিঙ্গারপ্রিন্ট যাচাই বাধ্যতামূলক করা হয়েছে। আবার ছবি ও চেহারা মিলিয়ে পরিচয় যাচাইয়ে একজন ব্যক্তির একাধিক এনআইডি তৈরীর মত ঘটনা ঘটে। এক্ষেত্রে দ্বৈত এনআইডির সমস্যাও দূর হয়েছে ফিঙ্গারপ্রিন্ট যাচাইয়ের মাধ্যমে। আবার একটা সময় বাংলাদেশীদের সাথে চেহারার মিলকে পূজি করে প্রায় আড়াই লক্ষ রোহিঙ্গা বাংলাদেশী পাসপোর্ট ব্যবহার করে বিদেশী পাড়ি জমায়, কিন্তু যখনই তাদের ফিঙ্গারপ্রিন্ট দিয়ে যাচাই শুরু হয়, তখনই রোহিঙ্গাদের প্রতারণা ধরা পড়ে এবং সমস্যার সমাধান হয়। ছবিকে পূজি করে গলাকাটা পাসপোর্ট সমস্যার সমাধান হয়েছে ই-পাসপোর্টে ফিঙ্গারপ্রিন্ট যাচাইয়ের মধ্য দিয়ে। আবার অনেক অসাধু শিক্ষার্থী চেহারার মিলকে ব্যবহার করে পরীক্ষায় প্রক্সি দেয়ার মত ঘটনা ঘটায়, যে দুর্নীতি ফিঙ্গারপ্রিন্ট যাচাইয়ে সহজেই সমাধান করা সম্ভব। আবার অপরাধীরা বার বার রূপ বদলানোয় আইনশৃঙ্খলাবাহিনীর জন্য চেহারা ও ছবি মিলিয়ে অপরাধীকে ধরা কষ্টসাধ্য হয়ে ওঠে। এই সমস্যা সমাধানে আইনশৃঙ্খলাবাহিনী অপরাধী সনাক্তে ফিঙ্গারপ্রিন্ট প্রযুক্তির আশ্রয় নিচ্ছেন। যেমন- এলিট ফোর্স র‌্যাব ফিঙ্গারপ্রিন্টের ‘ওআইভিএস’ প্রযুক্তি ব্যবহার করছে, পুলিশের সিআইডি ফিঙ্গারপ্রিন্টের ‘এএফআইএস’ প্রযু্ক্তি ব্যবহার করছেন। অর্থাৎ নির্ভুল যাচাইয়ের জন্য ফিঙ্গারপ্রিন্ট এখন সর্বাধুনিক ও গ্রহণযোগ্য মাধ্যম। উল্লেখ্য কৃত্তিম বুদ্ধিমত্তা বা আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স-এর যুগে ছবির অপব্যবহার অনেকাংশে বৃদ্ধি পেয়েছে। বর্তমানে এক ছবি একাধিক লোক ব্যবহারের প্রযুক্তিও আবিষ্কার হয়েছে। এসব কারণে আধুনিক বিশ্ব চেহারা ও ছবি মিলিয়ে পরিচয় যাচাইয়ে সেকেলে পদ্ধতি বর্জন করে ফিঙ্গারপ্রিন্ট (বায়োমেট্রিক) পদ্ধতি গ্রহণ করেছে।

 

সমাবেশে পর্দানশীন নারীরা তিনটি দাবী পেশ করেন

 

১. বিগত ১৬ বছর যাবত যে সমস্ত সাবেক ইসি কর্মকর্তা পর্দানশীন নারীদের নাগরিকত্ব আটকে রেখে মানবাধিকার বঞ্চিত করেছে তাদেরকে বিচারের আওতায় আনতে হবে।

২. পর্দানশীন নারীদের ধর্মীয় ও প্রাইভেসীর অধিকার অক্ষুন্ন রেখে অবিলম্বে এনআইডি ও শিক্ষা অধিকার প্রদান করা। সকল ক্ষেত্রে পরিচয় সনাক্তে চেহারা ও ছবি মেলানোর সেকেলে পদ্ধতি বাতিল করে আধুনিক ফিঙ্গারপ্রিন্ট যাচাই পদ্ধতি বাধ্যতামূলক করতে হবে।

৩. পর্দানশীন নারীদের ফিঙ্গারপ্রিন্ট নেয়ায় সময় পুরুষ নয়, নারী সহকারী বাধ্যতামূলক রাখতে হবে।

 

সমাবেশ শেষে পর্দানশীন নারীরা জেলা নির্বাচন কমিশনারের মাধ্যমে প্রধান নির্বাচন কমিশনারকে এবং জেলা শিক্ষা অফিসারকে স্মারকলিপি প্রদান করে। সমাবেশে প্রায় ৩ শতাধিক পর্দানশীন নারী উপস্থিত ছিলেন।