গরু জবাই নিষিদ্ধ করার কুফল: ভারতের দিকে তাকানো উচিত শ্রীলঙ্কার
আন্তর্জাতিক ডেস্ক: শ্রীলঙ্কা সরকার সংশ্লিষ্ট পক্ষগুলোর সাথে আলোচনা করে অক্টোবরে গরু জবাই নিষিদ্ধ করার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করবে বলে মনে হচ্ছে। প্রধানমন্ত্রী মহিন্দা রাজাপাকসার প্রস্তাবিত নিষেধাজ্ঞাটি শ্রীলঙ্কার ক্ষমতাসীন দল পদুজনা পেরামুনা (এসএলপিপি) আপত্তি ছাড়াই গ্রহণ করলেও বাইরে থেকে দৃশ্যত আপত্তি আসছে এবং সরকারি মুখপাত্রকে বলতে হয়েছে যে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হবে এক মাস পর।
এদিকে উগ্র বৌদ্ধ ও হিন্দু পরমপন্থীরা উল্লসিত। বৌদ্ধ সন্ন্যাসীদের একটি অংশ ও মুম্বাইভিত্তিক চরমপন্থী হিন্দুত্ববাদী দল শিব সেনার ক্লোন ‘শিব সেনাই’ বৌদ্ধ ও হিন্দুদের ত্রাণকর্তা হিসেবে মহিন্দা রাজাপাকসাকে অভিনন্দিত করেছে। গরুর গোশতের প্রধান ভোক্তা ও দোকানদার হিসেবে সবচেয়ে ক্ষতির মুখে পড়তে যাওয়া মুসলিমরা বলছে, এই প্রস্তাব এমন এক সময়ে নেয়া হচ্ছে যখন তা তাদের অর্থনৈতিকভাবে আঘাত করবে। ২০১৯ সালের সিরিজ বোমা হামলার কারণে তারা ইতোমধ্যেই রাজনৈতিকভাবে কোণঠাসা হয়ে পড়েছে।
শ্রীলঙ্কার সংখ্যাগরিষ্ঠ বৌদ্ধদের কাছে গরু বিবেচিত না হলেও প্রতিবেশী ভারতের হিন্দুবাদী প্রভাবে লোকজ সংস্কৃতিতে গরুর প্রতি সম্মান প্রদর্শন করা হয়। গরুর গোশত খাওয়ার ওপর কোনো বিধিনিষেধ না থাকলেও কোনো ব্যক্তি গরুর গোশত খাওয়া বর্জন করলে ও গরু রক্ষার প্রতিশ্রুতি দিলে তাকে ‘ভালো বৌদ্ধ’ বিবেচনা করা হয়। সিংহলি বৌদ্ধ শ্রীলঙ্কায় গরু সুরক্ষা নিয়ে গবেষণাপত্রে তাসমানিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের ড. জেমস স্টুয়ার্ট বলেছে, লোকরঞ্জক সিংহলি বৌদ্ধ সংস্কৃতিতে গরুকে বলা হয় ‘কিরি আম্মা’ বা দুধ মাতা, জীবনদাত্রী ও পুষ্টিদাতা এবং তা লঙ্ঘন করা উচিত নয়।
অবশ্য ১৯ শতকের শেষ দিকে ও বিশ শতকের প্রথম দিকে শ্রীলঙ্কায় হিন্দু, বৌদ্ধ ও মুসলিম পুনর্জীবন আন্দোলনের সময় গরু সংরক্ষণ ও গরুর গোশত খাওয়া সাম্প্রদায়িক ও রাজনৈতিক রঙ পায়। প্রখ্যাত সিংহলি-বৌদ্ধ পুনর্জীবনবাদী ও রাজনৈতিক কর্মী অনাগরিকা ধর্মপালা গরুর গোশত বর্জনের জন্য গণআন্দোলন গড়ে তোলেন। উল্লেখ্য, ১৯১৫ সালে শ্রীলঙ্কায় হয়েছিল সবচেয়ে ভয়াবহ মুসলিমবিরোধী দাঙ্গা।
কয়েক দশক পর জাতিগত সঙ্ঘাতের ফলে আবার গরু জবাইবিরোধী আন্দোলন চাঙ্গা হয়েছে। ২০০৯ সালে শ্রীলঙ্কার পার্লামেন্ট সিংহলি বৌদ্ধ জাতীয়তাবাদী এমপি বিজেদাসা রাজাপাকসার আনীত গরু জবাই নিষিদ্ধকরণ বেসরকারি বিল নিয়ে আলোচনা করে। ২০১২ সালের সেপ্টেম্বরে ক্যান্ডি মিউনিসিপ্যাল কাউন্সিল তার সীমানার মধ্যে গরু জবাই নিষিদ্ধ করে। হালাল প্রত্যায়ন ও বোরকা পরার মতো ইস্যুগুলো নিয়ে মুসলিমবিরোধী প্রচারণার সময়ই এসব ঘটনা ঘটে। বদু বালা সেনার (বিবিএস) মতো উগ্রপন্থী বৌদ্ধ সংগঠন এসব কাজে ব্যাপক প্রচারণা চালায়।
ভারতের অভিজ্ঞতা
ভারতে গরুর সুরক্ষা ও জবাইবিরোধী ভাবাবেগ উত্তপ্ত একটি রাজনৈতিক ইস্যু। ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনে মহাত্মা গান্ধী গরু সুরক্ষা ও গরুর গোশত পরিহার করাকে তার এজেন্ডার অংশে পরিণত করেছিল। ১৯৫০ সালে পাস হওয়া ভারতীয় সংবিধান গরুর সুরক্ষার ওপর জোর দেয়া হয়।
অবশ্য তথাকথিত সেক্যুলার কংগ্রেস সরকার ভারতে ওই আইন কঠোরভাবে পালন করেনি। হিন্দু জাতীয়তাবাদী সংগঠনগুলো অবশ্য বিক্ষোভ করেছিল। বেশ কয়েকটি রাজ্যে গরু জবাই নিষিদ্ধ হয় বা নিয়ন্ত্রণ করা হয়। ১৯৯০ ও ২০০০-এর দশকে উগ্র হিন্দুত্ববাদী রাজনীতি প্রাধান্য বিস্তার করে। বিশেষ করে ২০১৪ সালে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির নেতৃত্বাধীন ভারতীয় জনতা পার্টির (বিজেপি) ক্ষমতায় এলে ব্যাপক পরিবর্তন হয়। তারা ২০১৭ সালে গরু জবাই নিষিদ্ধ করে। এরপর থেকে জবাই করার জন্য গরু নিয়ে যাওয়া হচ্ছে সন্দেহে মুসলিমদেরকে পিটিয়ে হত্যা করার ঘটনা বেরে যায়। এমনকি ফ্রিজে গরুর গোশত রাখা সন্দেহে বা বহন করার সন্দেহেও পিটিয়ে হত্যা করার ঘটনা দেখা যায়।
নিষিদ্ধ করা সমস্যার কারণ
অবশ্য ভারতে গরু জবাইয়ের ওপর নিষেধাজ্ঞার বিরূপ প্রভাব নিয়ে অনেক লেখালেখি হয়েছে। আর তা শ্রীলঙ্কায় গরু জবাই নিষিদ্ধ করার সাথে প্রাসঙ্গিক।
জওহেরলাল নেহরু বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতিবিদ ড. বিকাশ রাওয়াল ২০১৭ সালে হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করে বলেছিলেন, গরুর ওপর এই নিষেধাজ্ঞা কার্যকর করতে হলে ভারতকে প্রতিরক্ষা বাজেটের ১.৫ গুণ বেশি অর্থ ব্যয় করত হবে গরুর যত্নে। অনুৎপাদনশীল গরুর জন্য ভারতকে অতিরিক্ত ব্যয় করতে হবে অতিরিক্ত ২৭০ মিলিয়ন ডলার।
সে বলেছিল, এই দেশে প্রতি বছর ৩৪ মিলিয়ন ষাড় বাছুর জন্ম নেয়। যদি ধরে নেয়া হয়, এসব গরু আট বছর বাঁচে, এটা সবচেয়ে কম হিসাব, তবে আট বছর শেষে অনুৎপাদনশীল গরুর সংখ্যা বাড়বে ২৭০ মিলিয়ন।
রাওয়ালের হিসাব অনুযায়ী, এর ফলে গরু পালনের বাজেট ৩৫ গুণ বেড়ে যাবে। গরুকে কেবল খাওয়ালেই চলবে না, সে যাতে ঘুরে না বেড়ায়, ফসল খেয়ে না ফেলে, তার জন্যও ব্যয় করতে হবে। তাছাড়া এসব গরুর আশ্রয়ের জন্য ৫ লাখ একর জমির প্রয়োজন হবে। এসব গরুর খাদ্য হিসেবে দিতে হবে সাত মিলিয়ন টন খাবার। এত খাদ্য উৎপাদনের মতো ভূমি ভারতে নেই। আর প্রতিটি প্রাণি যদি এক বালতি করে পানি পান করে, তবে মানুষের চেয়ে বেশি পানির প্রয়োজন হবে এসব প্রাণীর।
আবার গরিব ভারতীয় চাষীরা এসব অনুৎপাদনশীল পশুর ব্যয়ভার বহন করতে পারবে না। ফলে এসব গরুকে বাঁচিয়ে রাখার জন্য সরকারকেই বিলিয়ন বিলিয়ন রুপি ব্যয় করতে হবে। আবার অনুৎপাদনশীল গরু যদি সরকার পালন না করে এবং দুগ্ধ উৎপাদনকারীদেরই পুষতে হয়, তবে খামারিরা ডায়েরি ফার্ম প্রতিষ্ঠা এড়িয়ে যাবে। আর তাতে করে দুধের উৎপাদন কমে যাবে। এতে করে স্বাস্থ্য খাতে সৃষ্টি হবে মারাত্মক সমস্যা।
রাওয়াল বলেছে, ভারতে এখনই এক-তৃতীয়াংশ শিশু অপুষ্টির শিকার। ভারতে প্রতিবন্ধী শিশুর সংখ্যা ৬২ মিলিয়ন। বিশ্বের প্রতিবন্ধী শিশুর এক তৃতীয়াংশই আছে ভারতে।
নিষেধাজ্ঞার আরো বড় অর্থনৈতিক প্রভাব রয়েছে। সরকারি পরিসংখ্যান অনুযায়ী, ভারতে মাত্র ৩০ ভাগ গরু গোশতের জন্য জবাই করা হয় (স্থানীয়ভাবে খাওয়া কিংবা রফতানি)। ৭০ ভাগ মরা গরু বিভিন্ন শিল্পে চলে যায়। জবাই করা গরুর হাড় ও চামড়া বিভিন্ন শিল্পপণ্য হিসেবে ব্যবহৃত হয়। এগুলো চামড়াজাত পণ্য ছাড়াও টুথপেস্ট, বোতাম, পেইন্ট ব্রাশ, সার্জিক্যাল স্টিচ, মিউজিক্যাল ইন্ট্রুমেন্ট ইত্যাদি শিল্পে ব্যবহৃত হয়।
গরু জবাইয়ের ওপর নিষেধাজ্ঞার ফলে রফতানি মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। ২০১৪-১৫ সময়কালে ভারত ৬৫টি দেশে ভারত ২.৪ মিলিয়ন টন মহিষের গোশত রফতানি করেছে। অর্থাৎ বিশ্বের মোট রফতানির ২৩.৪ ভাগ ছিল ভারতের। আর যুক্তরাষ্ট্রের কৃষি দফতর জানিয়েছে, ভারতের গরু/মহিষের গোশত শিল্পের রফতানির মূল্য ৪ বিলিয়ন ডলার।
ইন্ডিয়া ব্র্যান্ড ফাউন্ডেশন ইকুইটির ওয়েবসাইটের তথ্য অনুযায়ী, ভারতের চামড়া শিল্প বিশ্বের মোট রফতানির ১২.৯৩ ভাগ করে থাকে। ভারতের গরু জবাই শিল্প ৫.৫ বিলিয়ন ডলারের চামড়া রফতানি করে থাকে। বিশ্বে জুতা ও লেদার গার্মেন্টস পণ্যে ভারত দ্বিতীয় স্থানে। বিশ্বের জুতা উৎপাদনে ভারতের হিস্যা ৯ ভাগ।
ভারতে প্রায় ২২ লাখ লোক গরু জবাই কাজের সাথে পরোক্ষ বা প্রত্যক্ষভাবে জড়িত। গরু জবাইয়ের সাথে ব্যাপকভাবে নির্ভরশীল চামড়া শিল্পে জড়িত আছে ৩৫ লাখ লোক।
একই ধরনের কথা শোনা যাচ্ছে শ্রীলঙ্কার ড. চন্দ্রে ধর্মাবর্ধনের মাধ্যমে। তিনি ২০১৯ সালে কলম্বো টেলিগ্রাফে লিখেছেন, ঘনবসতিপূর্ণ শ্রীলঙ্কা পশু পালনের জন্য আলাদা ভূমি ব্যবহার করতে পারবে না।