খুনি নাম বদলে কখনো বাবুর্চি, কখনো দারোয়ান

চট্টগ্রাম সংবাদাদাতা: ২০০২ সালের ৩০ মার্চ লোহাগাড়ার ব্যবসায়ী জানে আলম হত্যা মামলায় মৃত্যুদ-ে দ-িত আসামি। ২০০১ সালের ৯ নভেম্বর জানে আলমের ছোট ভাই হত্যা মামলার ২ নম্বর আসামি। এর আগে থেকে এলাকায় বিভিন্ন মারামারিতে অংশ নিয়ে দুর্ধর্ষ সৈয়দ বাহিনী নামে পরিচিতি লাভ করে। হত্যার পর থেকে কোনো ধরনের মোবাইল ব্যবহার করত না সৈয়দ আহমেদ।

নিজের নাম পরিবর্তন করে দুই আইডি কার্ড তৈরি করে সে। হত্যার পর থেকে সে কখনো ছিলো বাবুর্চি! কখনো দারোয়ান হিসেবে জীবিকা নির্বাহ করে। গত ২০ বছরে ধরে পরিবার-পরিজন ও আত্মীয়-স্বজনের সঙ্গে যোগাযোগ করতো না।

গততকাল জুমুয়াবার র‌্যাবের চান্দগাঁও ক্যাম্পে আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে এসব তথ্য তুলে ধরেন র‌্যাব-৭ এর অধিনায়ক লেফটেন্যান্ট কর্নেল এমএ ইউসুফ।

লেফটেন্যান্ট কর্নেল এমএ ইউসুফ বলেন, ২০০২ সালে ৩০ মার্চ সকালে ৯টার দিকে পূর্বশত্রুতার জের ধরে স্থানীয় কিছু দুষ্কৃতকারী ও সৈয়দ বাহিনী ব্যবসায়ী জানে আলমকে তার ১ বছরের শিশু সন্তানের সামনে নির্মম ও নৃশংসভাবে প্রথমে লাঠি, দেশীয় ধারালো অস্ত্র ও হাতুড়ি দিয়ে আঘাত করে এবং পরবর্তীতে মৃত্যু নিশ্চিত করার জন্য গুলি করে হত্যা করা হয়। এ ঘটনায় তার বড় ছেলে তজবিরুল আলম বাদী হয়ে লোহাগাড়া থানায় ২১ জনকে আসামি করে একটি হত্যা মামলা করেন। যার মধ্যে গ্রেফতার সৈয়দ আহম্মেদ ২ নম্বর আসামি।

এর মাত্র চার মাস আগে ২০০১ সালের ৯ নভেম্বর নিহতের আপন ছোট ভাইকেও একইভাবে নির্মম ও নৃশংসভাবে প্রথমে লাঠিসোঁটা, দেশীয় ধারালো অস্ত্র ও হাতুড়ি দিয়ে আঘাত করে এবং পরবর্তীতে মৃত্যু নিশ্চিত করার জন্য গুলি করে হত্যা করে। এ ঘটনায়ও লোহাগাড়া থানায় ১৩ জনকে আসামি করে একটি হত্যা মামলা করা হয়েছিল। ওই মামলাতেও সৈয়দ আহম্মেদ ২ নম্বর আসামি ছিলেন। এ মামলার রায় হবে আগামী ফেব্রুয়ারি মাসে। ব্যবসায়ী জানে আলম হত্যা মামলার রায়ে আদালত ২০০৭ সালে ২৪ জুলাই ১২ জনকে ফাঁসি এবং ৮ জনকে যাবজ্জীবন কারাদ-ে দ-িত করেন। রায়ের বিরুদ্ধে সুপ্রিম কোর্টে আপিল করলে গ্রেফতার সৈয়দ আহম্মেদসহ মোট ১০ জনকে মৃত্যুদ- ও ২ জনকে যাবজ্জীবন দেন।

তিনি বলেন, ব্যবসায়ী জানে আলম হত্যাকা-ের মূল কারণ আপন ছোট ভাইয়ের হত্যাকা-ের প্রত্যক্ষ সাক্ষী ছিলেন তিনি। মূলত জানে আলম পরিবারের বড় ছেলে এবং আর্থিকভাবেও কিছুটা সচ্ছলও ছিলেন। তাই মামলার ব্যয়ভার তিনি বহন করতেন। এতে প্রতিপক্ষের আক্রোশ তার ওপর দিন দিন বেড়ে যায়। প্রতিপক্ষের ধারণা ছিল যে, ব্যবসায়ী জানে আলকে হত্যা করলে ওই পরিবারের মামলা চালাবার তো কোনো লোক থাকবে না এবং প্রত্যক্ষভাবে আর কোনো সাক্ষীও থাকবে না। আর্থিকভাবে দুর্বল হয়ে পড়বে এবং তার সব সম্পত্তি সহজে তারা গ্রাস করতে পারবে। এ ভাবনা থেকে ঘাতক চক্র প্রকাশ্যে দিবালোকে ব্যবসায়ী জানে আলমকে নির্মম ও নৃশংসভাবে হত্যা করে।

র‌্যাব-৭ এর অধিনায়ক বলেন, প্রথম হত্যার পরপরই সৈয়দ আহম্মেদ বাঁশখালীর বিভিন্ন ডাকাত দলের সঙ্গে সমুদ্র পাড়ি দেয়। সেখান থেকে এসে ৪ মাস পরে আবার ব্যবসায়ী জানে আলমকে হত্যা করে বিভিন্ন জায়গায় আত্মগোপন করে থাকে। সে প্রথম ৪-৫ বছর তার পরিবার এবং আত্মীয়স্বজন ছেড়ে বাঁশখালী, আনোয়ারা, কতুবদিয়ায় ও পেকুয়ার সাগর উপকূলবর্তী এলাকায় থাকতে শুরু করে। পরবর্তীতে সীতাকু- এলাকায় উদ্বাস্তু হিসেবে বিভিন্ন জায়গায় ভুয়া ঠিকানা দিয়ে অবস্থান করে। এ ছাড়াও সে জঙ্গল ছলিমপুরে মশিউরের ছত্রছায়ায় ও সহযোগিতায় সেখানে স্থায়ীভাবে বসবাস করে। কিন্তু পুলিশ ও র‌্যাবের অভিযানে সেখানে নিরাপদ মনে না করে পুনরায় নগরের বিভিন্ন মাজার এলাকায় বাবুর্চির কাজ নিয়েছিল। এরপর নগরের আকবরশাহ থানায় একটি বাড়িতে দারোয়ানের ছদ্মবেশে কাজ নেয় এবং সেখানে স্থায়ীভাবে বসবাস শুরু করে।

তিনি বলেন, পলাতক থাকাকালীন গ্রেফতার সৈয়দ আহম্মেদ ভুয়া ঠিকানায় দুটি ভুয়া জাতীয় পরিচয়পত্র বানিয়ে ফেলে এবং তার পরিবার-পরিজন ও আত্মীয়স্বজনের সঙ্গে সম্পূর্ণভাবে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন রাখে। যার কারণে তাকে কোনোভাবেই ব্যবসায়ী জানে আলমের হত্যা মামলার আসামি বলে শনাক্ত করা যাচ্ছিল না। গত বৃহস্পতিবার (২৭ জানুয়ারি) বিকেলে গোপন সংবাদের ভিত্তিতে আকবরশাহ থানা এলাকায় জানে আলম হত্যা মামলার ২০ বছর ধরে উদ্বাস্তু ও দারোয়ান সেজে পলাতক মৃত্যুদ-াদেশপ্রাপ্ত সৈয়দ আহমেদকে গ্রেফতার করা হয়েছে।