চৈত্র সংক্রান্তি কি এবং কাদের?

বাংলা বছরের শেষ দিন অর্থাৎ চৈত্র মাসের শেষ দিনকে বলা হয় চৈত্র সংক্রান্তি। চৈত্র সংক্রান্তি প্রধানত সনাতনী সম্প্রদায়ের উৎসব হলেও কালের পরিক্রমায় বাংলার ভূখণ্ডে এটি আর সনাতনী আচার নয়, বরং এটি মিশে গেছে বাংলার চিরায়ত অসাম্প্রদায়িক বাঙালির সংস্কৃতির মাঝে। তাই চৈত্র সংক্রান্তি আজ ‘বাঙালি উৎসবে’ পরিণত হয়েছে।

হিন্দুরা এ দিনটিকে অত্যন্ত একটি পুণ্যদিন বলে মনে করে। এছাড়া সাধারনত এই বসন্তকালে বাসন্তী দেবী ও অর্ন্নপূর্ণাদেবীর পূজা অনুষ্ঠিত হয়ে থাকে।

হিন্দু পঞ্জিকা মতে চৈত্র সংক্রান্তির দিনটিকে গণ্য করা হয় মহবিষুব সংক্রান্তি নামে। হিন্দুরা পিতৃপুরুষের তর্পন করে থাকে, নদীতে বা দিঘীতে পুন্যস্নান করে থাকে।

বাংলা উইকিপিডিয়া সূত্রে জানা যায়, চৈত্র সংক্রান্তির প্রধান উৎসব চড়ক। চড়ক গাজন উৎসবের একটি প্রধান অঙ্গ।

এই উপলক্ষে একগ্রামের শিবতলা থেকে শোভাযাত্রা শুরু করে অন্য শিবতলায় নিয়ে যাওয়া হয়, একজন শিব ও একজন গৌরী সেজে নৃত্য করে এবং অন্য ভক্তরা নন্দি, ভৃঙ্গী, ভূত-প্রেত, দৈত্যদানব প্রভৃতি সেজে শিব-গৌরীর সঙ্গে নেচে চলে।

এ সময়ে শিব সম্পর্কে নানারকম লৌকিক ছড়া আবৃত্তি করা হয়, যাতে শিবের নিদ্রাভঙ্গ থেকে শুরু করে তার বিয়ে, কৃষিকর্ম ইত্যাদি বিষয় উল্লেখ থাকে।

এই মেলাতে সাধারণত শূলফোঁড়া, বানফোঁড়া ও বড়শিগাঁথা অবস্থায় চড়কগাছের ঘোরা, আগুনে হাঁটা প্রভৃতি সব ভয়ঙ্কর ও কষ্টসাধ্য দৈহিক কলাকৌশল দেখানো হতো। সময়ের পরিবর্তনের সাথে সাথে এই ধরণের খেলা একেবারেই কমে গেছে। তবে গ্রাম বাংলায় এদিনে বৈশাখী মেলাগুলোতে চড়ক গাছ নামক একধরণের বিনোদনমূলক রাইড প্রচলিত আছে, যেখানে চারজন করে বসার ব্যবস্থা থাকে এমন চার চার ১৬টি আসন উপর-নিচ ঘুড়তে থাকে। এটি মূলত চড়ক পূজার আদলেই করা হয়ে থাকে।

মাওলানা ভাসানী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতির প্রভাষক মনিরুজ্জামান মুজিব এই চৈত্র সংক্রান্তি সম্পর্কে বলেন, “চড়ক গাজন, স্নান, দান, ব্রত, উপবাস আর পূজা যদিও চৈত্র সংক্রান্তিতে হিন্দুরা করে থাকেন কিন্তু, আজ সেগুলো ছাপিয়ে এপার বাংলা আর ওপার বাংলার ২৫ কোটি বাঙালির প্রাণের উৎসবে পরিণত হয়েছে চৈত্র সংক্রান্তি আর পহেলা বৈশাখ – যা আজ অসাম্প্রাদিয়ক বাংলাদেশের সকল হিন্দু, মুসলিম, খ্রিস্টান, বৌদ্ধসহ সকল ধর্মের মানুষের প্রাণের উৎসব”।

শাস্ত্র ও লোকাচার অনুসারে এইদিনে স্নান, দান, ব্রত, উপবাস প্রভৃতি ক্রিয়াকর্মকে পূণ্যজনক বলে মনে করা হয়।

বাঙালী যে দিন চৈত্র সংক্রান্তির পালন করে থাকে সেদিন অদিবাসী সম্প্রদায় পালন করে থাকে তাদের বর্ষ বিদায় ও বর্ষবরন অণুষ্ঠান- বৈসাবি।

চৈত্র থেকে বর্ষার প্রারম্ভ পর্যন্ত সূর্যের যখন প্রচন্ড উত্তাপ থাকে তখন সূর্যের তেজ প্রশমন ও বৃষ্টি লাভের আশায় কৃষিজীবী সমাজ বহু অতীতে চৈত্র সংক্রান্তির উদ্ভাবন করেছিলেন বলে জানা যায় ইতিহাস ঘেটে।

চৈত্র সংক্রান্তিতে দেশজুড়ে এখন চলছে নানা ধরনের মেলা, উৎসব। হালখাতার জন্য ব্যবসা প্রতিষ্ঠান সাজানো, লাঠিখেলা, গান, আবৃত্তি, সঙযাত্রা, রায়বেশে নৃত্য, শোভাযাত্রাসহ নানা অনুষ্ঠান আর ভূত তাড়ানোর মধ্য দিয়ে উদযাপিত হবে চৈত্র সংক্রান্তি।

নতুন বছরকে বরণের প্রস্তুতির পাশাপাশি শেষ দিনটিতে থাকে বর্ষবিদায়ের নানা আয়োজন। চৈত্র সংক্রান্তিতে ওঝা সেজে হাতে ঝাড়ু নিয়ে বিশেষ ভঙ্গিমায় ছোট শিশুরা ভূত তাড়ানোর খেলায় মেতে ওঠে।

দেশের হিন্দুপ্রধান অঞ্চলে যুগ যুগ ধরে চৈত্র সংক্রান্তির নানা উৎসবের আয়োজন করা হয়। এর মধ্যে বারোয়ারি মেলা অন্যতম। বিশেষ করে নারায়ণগঞ্জ, মানিকগঞ্জ, ফরিদপুর, মাদারীপুর, গোপালগঞ্জ, বরিশাল, দিনাজপুরের ফুলছড়িঘাট এলাকা, কুমিল্লার লাঙ্গলকোট ও ঢাকার সাভার, ধামরাইয়ে চৈত্র সংক্রান্তির মেলা বসে।

চৈত্র সংক্রান্তির দিন সন্ন্যাসী বা সাধারণ লোকদের মধ্যে কাউকে কাউকে শূলফোঁড়া, বাণফোঁড়া ও বড়শিগাঁথা অবস্থায় চড়কগাছে চড়ে ‘ভয়ঙ্কর’ দৈহিক কলাকৌশল করতে দেখা যায়।

ঢাকার ধামরাইয়ে এখনও এটা নজরে পড়ে। পূণ্য লাভের আশায় ভয়াবহ এসব কুসংস্কারের প্রতি অন্ধ বিশ্বাস এবং অবৈজ্ঞানিক এই শারিরীক কসরত অবশ্য দিন দিন কমে আসছে।