জঙ্গিবাদ হারাম নয়, সঠিক ফতোয়া হলো ‘ইসলামে সন্ত্রাসবাদ হারাম’

মাওলানা বাহাউদ্দীন চিশতীঃ সম্প্রতি দেশের ধর্মব্যবসায়ী শ্রেণীর এক লক্ষ স্থুলবুদ্ধিসম্পন্ন কথিত আলেম “ইসলামের নামে জঙ্গিবাদ হারাম” নামক একটি ফতোয়াতে একমত হয়ে সই-স্বাক্ষর করে খুব বাহবা কামিয়েছে। কট্টর ইসলাম বিদ্বেষী ভারতও তাদের ফতোয়ায় খুশি হয়ে বাহবা দিয়েছে। আসলে ফতোয়াটির মধ্যে ভাষাগত মারাত্মক ভুল হয়েছে।

প্রকৃতপক্ষে সঠিক ফতওয়াটা হবে “ইসলামের নামে সন্ত্রাসবাদ হারাম।” জঙ্গিবাদ নয়।
জঙ্গি শব্দটা আসলে কোত্থেকে এসেছে? এটা হয়তো তাদের (ফতোয়া প্রদানকারী/স্বাক্ষরকারীদের) জানা নেই। ‘জঙ্গি’ শব্দটা এসেছে ফার্সি ‘জঙ্গ’ শব্দ থেকে। ‘জঙ্গ’ শব্দের বাংলা অর্থ যুদ্ধ। আরবিতে বলে জিহাদ। আর ‘জঙ্গি’ শব্দের অর্থ ‘যোদ্ধা’, যুদ্ধপ্রিয় ব্যক্তি, জিহাদী। যেমন- হযরত বড়পীর সাহেব রহমতুল্লাহি আলাইহির বাবার নাম ছিল হযরত আবু সালেহ মুসা জঙ্গিদোস্ত রহমতুল্লাহি আলাইহি। তিনি “জঙ্গ” অর্থাৎ যুদ্ধপ্রিয় ছিলেন এজন্যই উনাকে এই উপাধি দেয়া হয়। রাজধানীর কমলাপুরের নিকটবর্তী ‘পীরজঙ্গি মাজার’ নামে একটি মাজার শরীফ রয়েছে। মাজার শরীফে শায়িত ব্যাক্তি একজন জিহাদপ্রিয় ওলীআল্লাহ ছিলেন। যার কারণে তিনি ‘পীরজঙ্গি’ হিসেবে খ্যাতি লাভ করেন।
প্রকৃতপক্ষে “জঙ্গ” শব্দটি দ্বীন ইসলামেরই একটি শব্দ এবং ‘জঙ্গি’ একটি অত্যন্ত সম্মানিত উপাধি। যেমন- বাংলাদেশের স্বাধীনতার যুদ্ধে যারা সাহসীকতার পরিচয় দিয়েছেন তাদের বীরশ্রেষ্ঠ, বীরউত্তম উপাধি দেয়া হয়েছে। ঠিক তদ্রুপ সাহসিকতার সাথে যারা যুদ্ধ বা জিহাদ করে যারা গাজী হয়েছেন উনাদেরও আগে ‘জঙ্গি’ উপাধিতে ভূষিত করা হতো।
তাহলে এখন কথিত আলেমশ্রেণী ‘জঙ্গিবাদ হারাম’ বলে যে ফতোয়া প্রকাশ করলো সেটা ধরে নেয়া যায় তাদের ভাষাজ্ঞ্যানহীনতা। তাদের এই ফতওয়ার অর্থ দাড়ায় ইসলামে নামে জিহাদ বা যুদ্ধ হারাম। অথচ পবিত্র কুরআন শরীফ উনার মধ্যেই অনেকবার জিহাদের কথা এসেছে।
মহান আল্লাহ ইরশাদ করেছেন,  “তোমরা মহান আল্লাহর রাস্তায় তাদের (কাফিরদের) বিরুদ্ধে জিহাদ (যুদ্ধ) করো যারা তোমাদের বিরুদ্ধে জিহাদে (যুদ্ধে) অবতীর্ণ হয়।” (সূরা বাক্বারা: ৯০)
এখন ইসলামে জঙ্গিবাদ বা যুদ্ধবাদ যদি হারাম হয়, তবে পবিত্র কুরআনে অনেক স্থানে এভাবে জিহাদের করার কথা বলা হয়েছে, তাহলে এদের  ফতওয়া অনুসারে পবিত্র কুরআনের ঐ সকল আয়াত শরীফও বিতর্কিত হয়ে যায়। নাউযুবিল্লাহ!

আবার জঙ্গিবাদ বা জিহাদ যদি হারাম হয়, তাহলে শেষ নবী হুযূর পাক সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তিনি কিন্তু অনেকগুলো যুদ্ধ/জিহাদ করেছেন, সেগুলোও কিন্তু ফতওয়া অনুসারে হারাম হয়ে যাবে। নাউযুবিল্লাহ!

শুধু তাই নয়, বর্তমান আর্মি, নেভী, এয়ারফোর্সে ভর্তি হওয়াও মুসলমানদের জন্য হারাম হবে। কারণ সেখানে যুদ্ধবাদ প্রশিক্ষন দেওয়া হয়।

এখন ফতওয়াটি সংশোধন করা জরুরী। ফতওয়াটা- ‘ইসলামের নামে জঙ্গিবাদ হারাম না বলে’, ‘ইসলামের নামে সন্ত্রাসবাদ হারাম’ বলতে হবে। ইংরেজিতে Terrorism এর বাংলা অর্থ হচ্ছে সন্ত্রাসবাদ। এই Terrorism বা সন্ত্রাসবাদ ইসলামে হারাম বা নিষিদ্ধ।

এখন অনেকের মনে প্রশ্ন জাগতে পারে তাহলে এই ফতোয়ার নেপথ্যে কি কারণ থাকতে পারে?

ধারণা করা যায়, মুসলমানদের বিরুদ্ধে ধুরন্দর ইহুদী জাতির মনস্তাত্ত্বিক যুদ্ধের একটি অস্ত্র হচ্ছে টেরোরিজম এর বাংলা অর্থকে ‘জঙ্গিবাদ’ বলে প্রচার করা। আর প্রচারণাটি হয়েছে ইহুদীদের নিয়ন্ত্রিত গণমাধ্যমগুলো দিয়ে। ইহুদিরা সুদূরপ্রসারী প্ল্যান নিয়েই কাজ করে। আসলে এ ধরনের একটি ফতওয়া বর্তমান পরিস্থিতির জন্য ভালো মনে হতে পারে, কিন্তু সুদূর প্রসারী চিন্তা করলে অর্থাৎ কয়েকশ’ বছর পর মুসলমানরা যখন দেখবে লাখো আলেম এ ধরনের ফতওয়া দিয়েছিলেন, এমন দলিলে বিভ্রান্ত হয়ে ভবিষ্যত মুসলিম প্রজন্ম শত্রুর বিরুদ্ধে যুদ্ধ/জিহাদ থেকে দূরে সরে যাবে।

তাহলে ইহুদী-খ্রিষ্টানরা শত্রুর বিরুদ্ধে মুসলমানদের জিহাদ বা যুদ্ধকে ‘Terrorism’ (জঙ্গিবাদ) কেন বলছে?

এই কনসেপ্টটাও সবার পরিস্কারভাবে জানার দরকার আছে। পবিত্র কুরআনে কাফিরদের (অর্থাৎ ইহুদী, মুশরিক, খ্রিস্টান, বৌদ্ধ ইত্যাদি) আল্লাহ ও মুসলমানদের শত্রু হিসেবে চিহ্নিত করে অনেকগুলো আয়াত নাযিল হয়েছে। যেমন-
১) “নিশ্চয়ই কাফিররা মহান আল্লাহ তায়ালার সাথে শত্রুতা করে।” (সূরা বাকারা: ৯৮)

২) “হে ঈমানদারগণ! তোমরা আমার শত্রু এবংতোমাদের শত্রুকে বন্ধু হিসেবে গ্রহণ করো না।” (সূরা মুমতাহিনাহ: ১)

৩) “তোমরা (মুসলমানরা) তোমাদের সবচেয়ে বড় শত্রু হিসেবে পাবে প্রথমতঃ ইহুদীদেরকে অতঃপর মুশরিকদেরকে।” (সূরা মায়িদা: ৮২)

৪) “সুতরাং আপনারা তাদেরকে হত্যা করেননি, বরং মহান আল্লাহই তাদেরকে হত্যা করেছেন।” (সূরা আনফা: ১৭)

এরকম প্রায় ৭০০ আয়াত আছে পবিত্র কুরআনে। কোন কোন আয়াতে তাদের বিরুদ্ধে প্রয়োজনে জিহাদেও অবতীর্ণ হওয়ার কঠোর নির্দেশ দেয়া আছে। সঙ্গতকারণেই আল্লাহকে অস্বীকারকারী অমুসলিমদের কাছে ইসলাম এবং মুসলমান মানেই হচ্ছে ত্রাস-এর কারণ। আর তাই তারা মুসলমানদের যুদ্ধবিদ্যাকে ‘সন্ত্রাসবাদ’ বা ‘Terrorism’ বলে অ্যাখ্যায়িত করে থাকে।

আসা করা যায় জ্ঞানী মাত্রই জঙ্গি ও সন্ত্রাসবাদ শব্দ দুটির মধ্যে বিদ্যমান পার্থক্যটি স্পষ্টভাবে বুঝতে পারবে। এখানে কোন জটিলতা নেই। সাধারণভাবে মুসলমানমাত্রই সবাই জানেন শত্রুর বিরুদ্ধে ‘জিহাদ’ বা যুদ্ধ করার হুকুম ইসলামে রয়েছে। তাহলে এটা হারাম কেন হবে? অপরপক্ষে ইসলামের নামে মৌলবাদ, সন্ত্রাসবাদ সম্পূর্ণ নাজায়িয, হারাম ও কুফরী। কারণ মৌলবাদী-সন্ত্রাসবাদীরা ইসলামের নামে তথাকথিত জিহাদ করতে গিয়ে বোমাবাজির মাধ্যমে হত্যা, লুণ্ঠন, অপহরণসহ হাজারো শরীয়ত বিরোধী অপকর্মে লিপ্ত হয়ে যমীনে ফিৎনা-ফাসাদ সৃষ্টি করে তারা বিধর্মীদেরকে মুসলমানদের উপর নির্যাতনের সুযোগ তৈরি করে দেয়। ইসলাম সম্পর্কে মানুষকে পরিকল্পিতভাবে বীতশ্রদ্ধ করে তোলে। এদের সম্পর্কে কুরআন-এ মহান আল্লাহ ইরশাদ ফরমান, “কোন মুসলমানকে স্বেচ্ছায় হত্যা করলে তার স্থান জাহান্নামে।” (সূরা নিসা-৯৩)

আল্লাহ পাক আরো ইরশাদ ফরমান, “আমি বনী ইসরাইলের প্রতি লিখে দিয়েছি যে, কেউ প্রাণের বিনিময়ে প্রাণ অথবা পৃথিবীতে অনর্থ সৃষ্টিকারী ছাড়া কাউকে হত্যা করে, এরকম লোক সে যেন সব মানুষকেই হত্যা করে।” (সূরা মায়িদা-৩২)

তায়েফের ঘটনা আমরা সবাই অবগত। হযরত জিবরাইল আলাইহিস সালাম তিনি যখন আল্লাহ পাক উনার রসূল হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উনাকে আঘাতকারীদের দু’পাহাড় একত্র করে পিষ্ট করার অনুমতি চাইলেন তখন হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তিনি পরম দরদের সাথে বলেছিলেন, “এদেরকে যদি এভাবে মেরে ফেলা হয় তবে কাদের প্রতি আমি ইসলামের দাওয়াত পৌঁছাব? এরা না হোক, এদের বংশধররাও তো ইসলাম গ্রহণ করতে পারে।”

অতএব, যারা মনে করে বোমা মেরে ইসলাম কায়িম করবে তারা বিভ্রান্ত। মহান আল্লাহ ইরশাদ করেন, “তোমরা মানুষকে আল্লাহর পথে ডাক হিকমতের সাথে সুন্দর সুন্দর কথা দ্বারা।” (সূরা নহল-১২৫)