চিকুনগুনিয়া জ্বরে আতঙ্কের কিছু নেই

রাজধানীসহ সারা দেশে নতুন আতঙ্কের নাম চিকুনগুনিয়া। তবে স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা বলছেন, চিকুনগুনিয়া রোগে আতঙ্কের কিছু নেই। এই রোগে মৃত্যুর ঝুঁকি থাকে না। কোনো ব্যক্তি একবার চিকুনগুনিয়ায় আক্রান্ত হলে পরবর্তী সময়ে কখনোই এই রোগ হওয়ার আশঙ্কা থাকে না।

তারা বলেছেন, এডিস মশার কামড়ে এই ছড়ায়। তাই একটু সতর্ক থাকলে এই রোগে আক্রান্ত হওয়ার আশঙ্কাও কম থাকে।

এই রোগ সম্পর্কে জনসচেতনতা সৃষ্টিতে কাজ করছে ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশন। বুধবার বিকেলে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ে চিকুনগুনিয়া সম্পর্কিত একটি বৈঠক হয়। রোগতত্ত্ব, নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউট আইইডিসিআর চিকুনগুনিয়ার ব্যাপারে সচেতন থাকার পরামর্শ দিচ্ছে। এ ছাড়া বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয় আগামী ২১ মে রোববার চিকুনগুনিয়া জ্বর নিয়ে সেমিনারের আয়োজন করেছে।

ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের প্রধান স্বাস্থ্য কর্মকর্তা ব্রিগেডিয়ার জেনারেল এস এম এম সালেহ ভুঁইয়া বলেন, চিকুনগুনিয়া রোগের কারণে সাধারণত কোনো মানুষের মৃত্যু হয় না। একবার হলে জীবনে আর কখনো হয় না। তাই চিকুনগুনিয়া নিয়ে আতঙ্ক বা ভয়ের কিছু নাই।

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ের মেডিসিন অনুষদের ডিন অধ্যাপক ডা. এ বি এম আব্দুল্লাহ বলেন, চিকুনগুনিয়া ডেঙ্গু জ্বরের মতোই হয়। এটা ছড়ায় এডিস মশা। রোগীর ১০৪ থেকে ১০৫ ডিগ্রি জ্বর হয়। শরীরব্যথা, মাথাব্যথা ও গিরায় গিরায় প্রচণ্ড ব্যথা হয়। জ্বর কমার পরও এক থেকে দেড় মাস পর্যন্ত শরীর ও গিরায় ব্যথা থাকে।

ডেঙ্গু ‍ও চিকুনগুনিয়া রোগের মধ্যে কয়েকটি পার্থক্য তুলে ধরে তিনি বলেন, ডেঙ্গু জ্বরে রক্তক্ষরণের ঝুঁকি থাকে। চিকুনগুনিয়ায় রক্তক্ষরণের ঝুঁকি নেই। রোগীর রক্তক্ষরণ হয় না। তাই রোগীকে রক্ত দেওয়ারও প্রয়োজন হয় না। ডেঙ্গু চার রকমের ভাইরাস দ্বারা হয়, তাই চার বার হতে পারে। চিকুনগুনিয়া একবার হলে পরবর্তীতে আর হওয়ার আশঙ্কা থাকে না। চিকুনগুনিয়ায় মৃত্যুর ঝুঁকি একবারেই নাই। ডেঙ্গুতে মৃত্যু ঝুঁকি থাকে।

চিকুনগুনিয়া নিশ্চিত হওয়ার উপায় সম্পর্কে তিনি বলেন, এই রোগটা তো ভাইরাস দিয়ে হয়, তাই ভাইরাল অ্যান্টিবডি টেস্ট করা যেতে পারে। গ্রিন লাইফ শুরু করেছে, আইইডিসিআর শুরু করেছে। রোগীর লক্ষণ দেখে খুব সহজেই এই রোগ শনাক্ত করা যায়। টেস্ট করলেও করতে পারে, না করলেও চলে। এই রোগের জন্য টেস্টের দরকার আছে বলে মনে করি না। কারণ, টেস্ট করে নিশ্চিত হওয়া যাবে, কিন্তু চিকিৎসায় কোনো পার্থক্য আসবে না। সুতরাং টেস্ট করে টাকা খরচ করার দরকার পড়ে না।

তিনি বলেন, এই রোগ নিরাময়ের জন্য রোগীকে বিশ্রামে রাখতে হবে। প্যারাসিটারমল খেতে পারে, প্রচুর পরিমাণ পানি, সরবত, গ্লুকোজ, স্যালাইন খেতে হবে। ব্যথা না কমলে চিকিৎসকের পরামর্শমতো ব্যথানাশক ওষুধ খেতে পারে।

তিনি আরো বলেন, ঢাকায় এবার অনেক মানুষ চিকুনগুনিয়ায় আক্রান্ত হচ্ছে। প্রতিদিন ১৫ থেকে ২০ জন রোগী আমার কাছে এই রোগ নিয়ে আসছে। এ বছর বেশি হওয়ার কারণ হলো মাঝে মাঝে বৃষ্টি হচ্ছে। জমাটবাঁধা পানিতে এডিস মশা ডিম পাড়ছে। যত এই মশার বিস্তার হবে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকিও তত বাড়বে। এই মশা দিনে কামড়ায়। তাই দিনের বেলা সতর্কভাবে ঘুমাতে হবে। ঘরের আশপাশে কোথাও যেন পানি জমে না থাকে সেই দিকে খেয়াল রাখতে হবে।

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ের শিশুরোগ বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ডা. সোহেলা আখতার বলেন, এখন শিশুদের চিকুনগুনিয়া ভাইরাসের প্রকোপ চলছে। প্রতিদিনিই লোকজন এই রোগ নিয়ে আমাদের কাছে আসছে। এটা ডেঙ্গু ও জিকা ভাইরাসের মতো মশার মাধ্যমে ছড়াচ্ছে। বিএসএমএমইউতে চিকুনগুনিয়া রোগ শনাক্তের ব্যবস্থা আছে। পরীক্ষার নাম আইসিটি ফর চিকুনগুনিয়া। রোগীর প্রাথমিক লক্ষণ দেখে চিকুনগুনিয়া হতে পারে বলে মনে হলে আমরা পরীক্ষা করতে দেই। পরীক্ষার মাধ্যমে নিশ্চিত হওয়ার পর সে অনুযায়ী পরামর্শ দিয়ে থাকি।

তিনি বলেন, চিকুনগুনিয়া হলে জ্বরের সঙ্গে র‌্যাশ থাকবে। শরীরের জয়েন্টে পেইন থাকবে। শরীর খুবই দুর্বল হয়ে যাবে। ট্রিটমেন্ট ঠিকমতো করতে হবে। প্রচুর পরিমাণে পানি খেতে হবে। কোনো স্টরয়েড জাতীয় কিছু খাওয়া যাবে না। প্যারাসিটামল দিয়ে জ্বর কমাতে হবে। কোনো অ্যান্টিবায়োটিকের দরকার নেই। সুইটের যেন কোনো অভাব না হয়। শিশুদের ক্ষেত্রে জয়েন্ট পেইনটা খুব বেশি থাকে না। ছয় মাসের কম বয়সি শিশুরা আক্রান্ত হলে তাকে মায়ের দুধ খাওয়াতে হবে।

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ের ইন্টারনাল মেডিসিন বিভাগের অধ্যাপক ডা. মো. আবুল কালাম আজাদ বলেন, দুই-এক দিন পরপর বৃষ্টি হওয়ায় মশার উপদ্রপ বৃদ্ধি পেয়েছে। তাই চিকনগুনিয়া জ্বরের প্রকোপ কমছে না।

এই জ্বর নিয়ে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসাপাতালের (ঢামেক) বহির্বিভাগে প্রতিদিনই চিকিৎসা নিতে আসছেন অন্তত ২০ থেকে ২৫ জন রোগী। ঢামেকে এই জ্বরের এখনো কোনো ডায়াগনস্টিক পরীক্ষা শুরু হয়নি।

ঢামেকের আবাসিক চিকিৎসক ও মেডিসিন বিশেষজ্ঞ ডা. মোহাম্মদ শাইখ আব্দুল্লাহ বলেন, আমরা প্রাথমিকভাবে ডেঙ্গুর পরীক্ষা দিচ্ছি। যদি ডেঙ্গু জ্বর না ধরা পড়ে তাহলে আমরা ধরে নিচ্ছি চিকুনগুনিয়া।

সংবাদ মাধ্যমকে চিকুনগুনিয়া নিয়ে আতঙ্ক না ছড়ানোর আহ্বান জানিয়েছেন ডিএনসিসির প্রধান স্বাস্থ্য কর্মকর্তা। একটি সংবাদ মাধ্যমের নাম উল্লেখ করে ডিএনসিসির প্রধান স্বাস্থ্য কর্মকর্তা বলেন, ওই অনলাইন সংবাদ মাধ্যমটি চিকুনগুনিয়া নিয়ে আতঙ্ক ছড়ানোর মতো একটি সংবাদ পরিবেশন করেছে।

চিকুনগুনিয়া রোধে এবং যাতে মানুষ আতঙ্কিত না হয়ে সেজন্য ডিএনসিসি তৎপরতা বাড়িয়েছে। সেই সঙ্গে জনসচেতনতা ও কেমিক্যাল কন্ট্রোলের ওপর ‍গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে। জনসচেতনতায় প্রচার-প্রচারণা ও পোস্টার-লিফলেট বিতরণে জোর দেওয়া হচ্ছে বলেও জানান এই কর্মকর্তা।

ডিএনসিসির প্রচারপত্রে ডেঙ্গু ও চিকুনগুনিয়া রোগ প্রতিরোধে করণীয় সম্পর্কে বলা হয়েছে, ফুলের টব, প্লাস্টিকের পাত্র, পরিত্যক্ত টায়ার, প্লাস্টিকের ড্রাম, মাটির পাত্র, বালতি, টিনের কৌটা, ডাবের খোসা, নারিকেলের মালা, কন্টেইনার, মটকা, ব্যাটারির শেল, পলিথিন/চিপসের প্যাকেট ইত্যাদিতে জমে থাকা পানিতে এডিস মশা ডিম পাড়ে। বাড়িঘরের আশপাশে যেকোনো পাত্র বা জায়গায় জমে থাকা পানি তিন দিন পরপর ফেলে দিলে এডিস মশার লার্ভা মরে যাবে। পাত্রের গায়ে লেগে থাকা মশার ডিম অপসারণে পাত্রটি ঘষে পরিষ্কার করতে হবে।

দিন ও রাতে ঘুমানোর আগে অবশ্যই মশারি ব্যবহার করতে হবে। মশা যেহেতু শরীরের খোলা জায়গায় কামড় দেয়, তাই যতদূর সম্ভব শরীর পোশাকে আবৃত রাখতে হবে। প্রয়োজনে শরীরের অনাবৃত স্থানে মশানিবারক ক্রিম/লোশন ব্যবহার করা যেতে পারে (মুখমণ্ডল ব্যতীত)।সম্ভব হলে জানালা-দরজায় মশা প্রতিরোধক নেট লাগাতে হবে, যাতে মশা প্রবেশ করতে না পারে। বর্ষার সময় এই রোগের প্রকোপ বাড়তে পারে, তাই এ সময়ে অধিক সতর্ক থাকা প্রয়োজন।

আইইডিসিআর থেকে জানা যায়, ১৯৫২ সালে চিকুনগুনিয়া প্রথম ধরা পড়ে আফ্রিকায়। পরে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে বিস্তার ঘটে। ২০০৮ সালে চিকুনগুনিয়া বাংলাদেশে প্রথম ধরা পড়ে রাজশাহী ও চাঁপাইনবাবগঞ্জে। তিন বছর পরে ২০১১ সালে ঢাকার দোহারে এই রোগের প্রাদুর্ভাব দেখা যায়। পরে বিচ্ছিন্ন দু-একটি রোগী ছাড়া বাংলাদেশে এ রোগ দেখা যায়নি।