নির্মম হত্যাকাণ্ড: ‘গ্রামগুলো জ্বলছে, রামদা-তলোয়ার হাতে বৌদ্ধ ভিক্ষু সন্ত্রাসীরা’

ডেস্ক: কোনো বিদ্রোহী গোষ্ঠী নয়, সেনাবাহিনীর সাথে মিলেমিশে স্থানীয় বৌদ্ধ ভিক্ষু ও তরুণরাই সেখানকার রোহিঙ্গা মুসলমানদের উপর অত্যাচার ও নির্যাতন চালাচ্ছে। রোহিঙ্গাদের বাড়িঘরে আগুন দিয়ে পুড়িয়ে দিচ্ছে। তলোয়ার আর রামদা হাতে টহল দিচ্ছে বৌদ্ধ তরুনরা সারাক্ষণ। তাদের সামনে পড়ার ভয়ে রোহিঙ্গারা নিজেদের ভিটেবাড়ি ফেলে বাংলাদেশে ঢুকে পড়ছে।
এক প্রতিবেদনে এক সাংবাদিক লিখেছেন, ‘গাড়ি তখন মংডু জেলার গাউদু যারা গ্রামের পাশ দিয়ে যাচ্ছিল। সাধারণত গ্রামের চিহ্ন হিসেবে ধানক্ষেত থাকে। আমাদের পেছনে ধানক্ষেতগুলোর মধ্যে সারিবদ্ধ গাছের ভেতর থেকে ধোঁয়ার কুন্ডলী দেখতে পেলাম। আমরা গাড়ি থেকে বের হলাম এবং ধানক্ষেত পেরিয়ে সেখানে যাওয়ার জন্য দৌড় দিলাম। প্রথমেই দেখতে পেলাম গ্রামের ভবনগুলো কেবল জ্বলছে।
গাওদু যারা গ্রামের বাড়িগুলো ২০ থেকে ৩০ মিনিটের মধ্যে ছাইয়ে পরিণত হয়ে গেল। মাত্র কিছুক্ষণ আগেই এখানে অগ্নিসংযোগ করা হয়েছে। একটু হেঁটে যাওয়ার পর একদল উগ্রতাবাদী বৌদ্ধ ভিক্ষু ও তরুণদের রামদা, তলোয়ার ও গুলতি হাতে চলে যেতে দেখলেন সাংবাদিকরা। তারা তাদের সঙ্গে কথা বলার চেষ্টা করলে তারা ক্যামেরার সামনে কথা বলতে অস্বীকৃতি জানায়। তারা ছিল সবাই রাখাইন বৌদ্ধ। তাদের মধ্যে একজন স্বীকার করল, সে গ্রামে অগ্নিসংযোগ করেছে এবং পুলিশ তাকে সহযোগিতা করেছে।
মংড়ুর পরিস্থিতি দেখতে আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমের ২৪ জন সাংবাদিকের একটি দল সেখানে যায়। তবে তাদের জন্য পূর্বশর্ত ছিল সাংবাদিকরা দলবদ্ধ থাকবেন এবং স্বাধীনভাবে ঘোরাফেরা করতে পারবেন না। নিরাপত্তা বাহিনীর পাহারায় সরকারের বাছাই করা স্থানে যেতে হবে তাদের। সবসময় অন্যান্য এলাকায়, এমনকি কাছের কোনো স্থানেও তাদের যাওয়ার প্রস্তাব বাতিল করা হয়েছিল নিরাপত্তার অজুহাতে।
ওই প্রতিবেদনে অন্য আরও কয়েকটি গ্রামের রোহিঙ্গা চিত্র তুলে ধরে তিনি লিখেছেন ‘আমরা আর একটি গ্রামে গেলাম। সুনসান নীরবতা, কোনো মানুষই নেই। রাস্তার ওপর গৃহস্থালি সামগ্রী, শিশুদের খেলনা, নারীদের কাপড়চোপড় ছড়িয়ে-ছিটিয়ে পড়ে ছিল। রাস্তার মাঝে একটি খালি জগ দেখতে পেলাম যেটার ভেতর থেকে তখনও পেট্রোলের ঝাঁজ বের হচ্ছিল, আরেকটি পড়ে থাকা জগে কিছুটা পেট্রোল অবশিষ্ট ছিল। যখন আমরা বের হয়ে আসছিলাম, তখন পোড়া বাড়িগুলোতে আগুন ধিকিধিকি করে জ্বলছিল, কালো ধোঁয়ায় ছেয়ে যাচ্ছিল চারপাশ। চলতি পথে মাঝে মাঝে যাদের দেখেছিলাম, তারা ছিল হামলাকারী।’
আরেকটু সামনে এগোনোর পর একটি মাদ্রাসা দেখতে পেলাম যেটির ছাদ তখনও জ্বলছে। আগুন আরেকটি বাড়ির পাশে ছড়িয়ে পড়ায় তিন মিনিটের মাথায় সেটি রীতিমতো নরকে পরিণত হলো।
বাস্তুচ্যুত রোহিঙ্গারা যেসব দেশে আশ্রয় নিয়েছে-
১৯৪৮ সালে স্বাধীন বার্মা রাষ্ট্র সৃষ্টির পর অসংখ্যবার রোহিঙ্গা মুসলিমদের ওপর অত্যাচারের লোমহর্ষক ঘটনা ঘটেছে। এসব ঘটনায় অসংখ্য প্রাণহানির পাশাপাশি হাজার হাজার রোহিঙ্গা হয়েছেন বাস্তুহারা। ভিটেমাটি ছেড়ে দেশান্তরিত হয়েছে বহুবার। মূলত ১৯৭০ সাল থেকে রোহিঙ্গারা মিয়ানমার ছাড়তে শুরু করেন। আর গত সাড়ে চার দশকে ১০ লাখের বেশি রোহিঙ্গা নিজ দেশ ছেড়ে পাড়ি জমিয়েছেন অন্যত্র। বাংলাদেশ ছাড়াও মালয়েশিয়া, ইন্দোনেশিয়া, ভারত, পাকিস্তান, সঊদি আরবসহ বিভিন্ন দেশে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে আছেন তারা।
নতুন করে সহিংসতা শুরুর পর গত দুই সপ্তাহে প্রায় ৩ লক্ষাধিক রোহিঙ্গা প্রবেশ করেছেন বাংলাদেশে। তবে জাতিসংঘের শরণার্থীবিষয়ক সংস্থার (ইউএনএইচসিআর) মতে, এর সংখ্যা ২ লাখ ৭০ হাজার। অত্যাচার-নির্যাতনের মুখে মিয়ানমারের রাখাইন ছেড়ে বঙ্গোপসাগর ও আন্দামান সাগর পাড়ি দিয়ে মালয়েশিয়াতে আশ্রয় নিয়েছেন অন্তত ১ লাখ ১২ হাজার রোহিঙ্গা। ২০১২ থেকে ২০১৫ পর্যন্ত ৩ বছরে তারা মালয়েশিয়ায় আশ্রয় নিয়েছেন। গত আগস্টে নতুন করে সহিংসতা শুরুর আগে জাতিসংঘ প্রাথমিকভাবে জানিয়েছিল, দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার বিভিন্ন দেশে প্রায় ৪ লাখ ২০ হাজার রোহিঙ্গা রয়েছেন। এ সময় আরও ১ লাখ ২০ হাজার রোহিঙ্গা অভ্যন্তরীণভাবে বাস্তুচ্যুত হওয়ার কথাও বলা হয়।
আল-জাজিরার প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, সঊদি আরবে রয়েছে ২ লাখ, পাকিস্তানে সাড়ে ৩ লাখ, মালয়েশিয়ায় দেড় লাখ, ভারতে ৪০ হাজার, সংযুক্ত আরব আমিরাতে ১০ হাজার, থাইল্যান্ডে ৫ হাজার এবং ইন্দোনেশিয়ায় ১ হাজার রোহিঙ্গা অবস্থান করছেন।
স্বাস্থ্য ঝুঁকিতে সীমান্তে আশ্রয় নেয়া রোহিঙ্গা শিশু ও প্রসূতিরা-
কক্সবাজার সংবাদদাতা: মিয়ানমারের জাতিগত সহিংসতার শিকার হয়ে সর্বস্ব হারিয়ে বাংলাদেশ সীমান্তে আশ্রয় নেয়া রোহিঙ্গার দশ হাজারেরও বেশি শিশু চরম স্বাস্থ্য ঝুঁকিতে রয়েছে। গত ২ সপ্তাহে অভূক্ত থেকে অসুস্থ্য হয়ে মারা গেছে অন্তত ১৫০ শিশু। বাড়ছে শিশুও। প্রসূতি মাও মারা গেছে দশ জন। ক্রমশঃ এ সংখ্যা বেড়েই চলছে। এই তথ্য জানা গেছে কুতুপালং এমএসএফ হাসপাতাল ও সীমান্তের বিভিন্ন মেডিকেল টিম থেকে প্রাপ্ত সূত্রে।
অন্যদিকে মিয়ানমার থেকে আগত শিশুদের প্রাণঘাতি টিকা দেয়া নাই। তাই ব্যাপকহারে হাম রুবেলা, ডায়রিয়া ছড়িয়ে পড়ার আশঙ্কা করা হচ্ছে। অর্ধাহারে অনাহারে দূর-দূরান্ত থেকে আসা বিশেষতঃ নারী-শিশু-বৃদ্ধের দুঃখ দুর্দশাগ্রস্থ হাজার হাজার রোহিঙ্গাদের মাঝে তীব্র খাদ্য সংকট প্রকট আকার ধারন করছে। তাই ক্ষুধার্ত মা শিশুকে বুকের দুধ দিতে না পারায় হাড্ডিসার অবস্থা রোহিঙ্গা শিশুদের। গত কয়েকদিনে সীমান্ত পয়েন্ট দিয়ে ঢুকে পড়া এসব রোহিঙ্গারা অনাহারে অর্ধাহারে ছুটছে অনিশ্চিত গন্তব্যে। ঢুকে পড়া এসব রোহিঙ্গারা সর্বত্রই গন্তব্যহীনভাবে এদিক সেদিক ছুটাছুটি করছে।
এই বিপুল সংখ্যক রোহিঙ্গাদের খাদ্য সংকট ও তাদের শিশুদের মৃত্যুর সংখ্যা আশংকা জনকহারে বৃদ্ধি পাওয়ায় মানবিক বিপর্যয়ের আশংকাও করছে অনেকেই।
অনেক গর্ভবতী নারী সীমান্তের দূর্গম পথ পাড়ি দিতে গিয়ে অসময়ে সন্তান প্রসব করেছেন। নতুন আশ্রয় নেয়া রোহিঙ্গাদের ঠিকমত চিকিৎসা করার কোন সুযোগ নেই। কুতুপালং এমএসএফ হাসপাতালের স্বাস্থ্য সেবা প্রয়োজনের তুলনায় অপ্রতুল। খাদ্য সংকটাপন্ন অবস্থা মোকাবেলা করার পাশাপাশি চিকিৎসা সেবার উপর জোর দেয়া প্রয়োজন আন্তজার্তিক সম্প্রদায়ের। শরণার্থী শিবিরের এনজিও কর্মীরা জানিয়েছেন, তাদের জনবলের সংখ্যার চেয়ে বিপিেরত রোগীর সংখ্যা বৃদ্ধি পাওয়ায় সাস্থ্য সেবা দেয়া খুব কঠিন হয়ে দাঁড়িয়েছে। যারা শরণার্থী শিবিরের কাছাকাছি অবস্থান করছে তারা দেরীতে হলেও চিকিৎসা পাচ্ছে। কিন্তু যারা সীমান্তবর্তী গ্রামে এবং জিরো পয়েন্টে অবস্থান করছে বিনা চিকিৎসায় চরম স্বাস্থ্যহানী হচ্ছে তাদের।