শত দিন পার করেছে অবরুদ্ধ কাশ্মীর

সন্ত্রাসবাদের তকমা দিয়ে কাশ্মীরে নির্যাতন বাড়াচ্ছে ভারত

আন্তর্জাতিক ডেস্ক :সমান। দুর্দশা আমাদেরকে ঘিরে ধরেছে, যা বর্ণনা করা যায় না – অনুতাপের সুরে কথাগুলো বললেন শ্রীনগরের পুরনো অংশের বাসিন্দা মোহাম্মদ সোবহান সুফি। ৫ আগস্ট কাশ্মীরে অবরোধ আরোপ করার আগে ফুটপাতে পোশাক বিক্রি করতেন তিনি।

৫৪ বছর বয়সী এই প্রবীণ লোকটি জানান যে এখনকার চেয়ে ১৯৯০-এর দশকে কাশ্মীরের সবচেয়ে গুরুতর বিদ্রোহকবলিত দিনগুলো অনেক ভালো ছিলো।

কাশ্মীরকে অবরুদ্ধ করার ১০০ পার হয়েছে গত ১৫ নভেম্বর। কিন্তু কোথাও স্বাভাবিকতার লক্ষণ দেখছেন না উপত্যকার ৭০ লাখ বাসিন্দা। বাজারে হৈচৈ, পথে যানবাহনের বেপরোয়া ছুটে চলা, ট্রাফিক বাতির জ্বলা-নেভা, বর্ণাঢ্য পোশাক পরে স্কুল শিশুদের বাসের জন্য সারিবদ্ধভাবে দাঁড়িয়ে থাকা, মোবাইল ফোনের বিচিত্র রিংটোন কিছুই নেই কোথাও। তারা গুগলে প্রবেশ করতে পারেননি, ইন্টারনেট নেই।

সুফি বলেন, এই ডিজিটাল যুগে মোবাইল ফোন ও ইন্টারনেট থাকার পরও মানুষ এগুলো ব্যবহার করতে পারছে না – এমন কোন জায়গা কি কোথাও আছে? বাইরে কারফিউ, কোথাও স্বাভাবিক কাজকর্ম নেই। মানব বসবাসের জন্য সবচেয়ে অনুপযুক্ত জায়গায় পরিণত হয়েছে কাশ্মীর।

১৯৪৭ সালে ব্রিটিশদের কাছ থেকে স্বাধীনতা লাভের পর থেকেই কাশ্মীর সমস্যা বিরাজ করছে, যখন হিন্দু সংখ্যাগুরু জায়গাগুলো নিয়ে ভারত ও মুসলিম সংখ্যাগুরু জায়গাগুলো নিয়ে পাকিস্তান রাষ্ট্র গঠিত হয়।

তখন মুসলিম সংখ্যাগুরু অঞ্চল কাশ্মীর শাসন করত হিন্দু রাজা হরি সিং, সে ভারতে যোগ দেয়া পছন্দ করেছে। কিন্তু কাশ্মীরের ক্ষুব্ধ জনগণকে শান্ত করতে সিং ও ভারত এমন বেশ কিছু ছাড় দিতে রাজি হয় যা স্বায়ত্তশাসনের কাছাকাছি ছিলো। এই অঞ্চলের বাইরে থেকে কাউকে এখানে এসে সম্পত্তি কেনার অধিকার রহিত করা হয়।

গত ৫ আগস্ট, ভারতের হিন্দুত্ববাদী নরেন্দ্র মোদি সরকার মুসলিম সংখ্যাগুরু কাশ্মীরের স্বায়ত্তশাসন ও রাজ্য মর্যাদা বাতিল করে সংবিধান সংশোধন করে। বিরোধী রাজনীতিক, মানবাধিকার কর্মী ও স্বাধীনতাকামীসহ চার হাজারের বেশি মানুষকে আটক করা হয়। সড়ক বন্ধ করে দেয়া হয়, সড়কজুড়ে অসংখ্য সেনাসদস্য মোতায়েন করা হয়, যোগাযোগের সকল ব্যবস্থা – ল্যান্ডফোন, মোবাইল, ইন্টারনেট – বন্ধ করে দেয়া হয়।

কাশ্মীরবাসী মোদি সরকারের সিদ্ধান্তের প্রতিবাদে সব ধরনের নিয়মিত কাজকর্ম যেমন: অফিসে যাওয়া, সন্তানদের স্কুল-কলেজে পাঠানো, দোকানপাঠ-ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান খোলা থেকে বিরত থাকে।

সুফি বলেন, এমনকি আফ্রিকার গহীন জঙ্গলেও ফোনের শব্দ শোনা যায়। ভূস্বর্গ হিসেবে অভিহিত এই এলাকাটি আক্ষরিক অর্থেই গোলাবারুদের ডিপোতে পরিণত করা হয়েছে। এখানকার জনগণের কাছ থেকে শান্তিতে বসবাস করার অধিকারও কেড়ে নেয়া হয়েছে।

তবে এই অশান্ত অঞ্চলের জনগণ এবার স্বায়ত্তশাসন ফিরে না পাওয়া পর্যন্ত তাদের রুটিন কাজকর্মক শুরু না করার ব্যাপারে দৃঢ় প্রতিজ্ঞ। তিনি বলেন, রাজনীতি বাদ দিন। এটা আমাদের পরিচিতি ও পাঁচ হাজার বছরের ইতিহাসের প্রশ্ন। বাইরে থেকে লোকজন এসে এখানকার পুরো চেহারাটাই পাল্টে দেবে – সেটা আমরা কীভাবে মেনে নিতে পারি?

সুফির বয়সের অর্ধেক বয়সী হবে এমন এক কলেজ ছাত্র ইলিয়াস মুবিনের কণ্ঠেও একই সুর। তার মতে ভারত সরকার কাশ্মীরী জনগণের সামনে বিশেষ মর্যাদা বাতিলের সিদ্ধান্ত প্রতিরোধ করা ছাড়া আর কোন বিকল্প খোলা রাখেনি।

মুবিন বলেন, আজ জনগণ একাট্টা। ১০০ দিন কেন ১,০০০ দিন গেলেও কিছু হবে না। আমাদের মনোবল আরো দৃঢ় ও অনমনীয় হবে। সরকার আমাদের সঙ্গে ক্ষমার অযোগ্য কাজ করেছে। তারা যোগাযোগের মতো আমাদের মৌলিক অধিকারও হরণ করেছে। মাসের পর মাস মোবাইল ফোনতো দূরের কথা আমাদের ল্যান্ডফোনগুলোও অচল করে রাখা হয়েছে। জরুরি মুহূর্তে আমরা এম্বুল্যান্স বা ফায়ার সার্ভিসও ডাকতে পারি না। দুনিয়ার কোথাও কি এমনটা হয়েছে?

দক্ষিণ কাশ্মীরের পুলওয়ামা জেলার বাসিন্দা ইমতিয়াজ আহমেদ মির বলেন, যোগাযোগের সবরকম সুযোগ থেকে বিচ্ছিন্ন অবস্থায় ঘরে বন্দী হয়ে থাকার মতো গুরুতর পর্যায় পার করে এসেছে জনগণ। এর চেয়ে খারাপ পরিস্থিতি আর কি হবে। রাস্তাঘাটে আপনি ক্ষোভ ছাড়া আর কিছু দেখবেন না। যা ঘটছে তা মেনে নেয়ার মতো অবস্থায় নেই জনগণ। ১০০ দিন বা এক বছর পার হলেও কিছু যায় আসে না।

কাশ্মীর বিশ্ববিদ্যালয়ের এই পিএইচডি গবেষক জানান যে, ৫ আগস্ট থেকে কাশ্মীরবাসী যে দু:সহ জীবন যাপন করছে তা অবর্ণনীয়। ১০ বছরের শিশু থেকে ৮০ বছরের বৃদ্ধ পর্যন্ত নির্বিচারে লোকজনকে আটক করে পুলিশের গাড়ি বোঝাই করে নিয়ে যাওয়া হয়েছে।

মির বলেন, মানবাধিকারের এই লঙ্ঘন সম্পর্কে সবাই জানে। তুমি পুরো জাতিকে তুলে নিয়ে যেতে পারো না। পুরনো প্রবাদ আছে যে তুমি যদি বিড়ালকে কোনঠাসা করো তাহলে সে বাঘে পরিণত হবে।

পিপলস ডেমক্রেটিক পার্টির (পিডিপি) নেতা ও কাশ্মীরের সাবেক মুখ্যমন্ত্রী মেহবুবা মুফতি বলেন, কাশ্মীরের জনগণ ও বাকি ভারতের মধ্যে আজ যে দূরত্ব তৈরি হয়েছে আগে কখনো তেমনটা হয়নি। তার টুইটার একাউন্ট এখন দিল্লিতে বসে অপারেট করছেন তার মেয়ে। তাতে তিনি লিখেন: কাশ্মীরবাসী যখন জম্মু-কাশ্মীরকে হত্যার জন্য শোক প্রকাশ করছে তখন বাকি ভারত এর জন্য পৈশাচিক উল্লাস করেছে। তোমার ও আমার মধ্যে আবেগের যে দুস্তর ব্যবস্থান তার কোন পরিমাপ নেই। তোমরা আমাদের সম্মতি ও অধিকার লঙ্ঘন করেছে কিন্তু আমাদের অনুভুতি কখনো নিয়ন্ত্রণ করতে পারবে না। কাশ্মীর চিরজীবী হবে ইনশাল্লাহ।

ভারত ও পাকিস্তান দুই দেশই পুরো কাশ্মীরের দাবিদার। এ নিয়ে তারা অন্তত তিনটি যুদ্ধ করেছে। অসংখ্য ছোটখাট সংঘর্ষ হয়েছে।

অঞ্চলটিকে ভারতের কবল থেকে মুক্ত করার জন্য স্বাধীনতাকামীদের আন্দোলনে পাকিস্তান সমর্থন দিচ্ছে বলে নয়া দিল্লি প্রায়ই অভিযোগ করে। তবে পাকিস্তান বারবার এই অভিযোগ অস্বীকার করে এসেছে। স্বাধীনতা আন্দোলন তীব্র হয়ে ওঠার পর থেকে গত তিন দশকে অন্তত এক লাখ মানুষ প্রাণ হারিয়েছে।

নেতারা সংঘাত পরিহার করে সংলাপ শুরু করার আহ্বান জানিয়েছেন। অতীতের আলোচনাগুলো কোন স্থায়ী সমাধান খুঁজে পায়নি। আর সর্বশেষ আলোচনা শুরুই হতে পারেনি কারণ দুই পক্ষই শর্ত জুড়ে দেয়।

প্রখ্যাত ভারতীয় লেখক ও প্রতিরক্ষা বিশেষজ্ঞ প্রবীণ শাওনি বলেন, ৫ আগস্ট ভারত সরকার কাশ্মীর ও সেখানকার জনগণকে হারিয়েছে। আমরা কখনো কাশ্মীর, সেখানকার জনগণকে পাত্তা দেইনি এবং শেষ পর্যন্ত তাদেরকে ৫ আগস্ট হারিয়ে ফেললাম। এক টুইটে শাওনি বলেন, সামনে দুটি বিকল্প রয়েছে: আমাদের সঙ্গে এমন একটি ভূখণ্ড থাকবে যেখানকার অধিবাসীরা হবে পুরোপুরি বিরূপ মনোভাবের। এতে আমাদের জাতীয় নিরাপত্তার জন্য উপকার হবে না। অথবা আমাদেরকে দুটোই হারাতে হারাতে, আজ বা কাল নয়, এমন সময় এটা ঘটবে যা আমরা ঠিক করে দিতে পারবো না।