নিখোঁজদের তালিকায় শতাধিক তরুণের নাম

ঢাকা: সন্ত্রাসবাদী তৎপরতার সঙ্গে সম্পৃক্ত হওয়ার জেরে রহস্যজনকভাবে পরিবার থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে নিখোঁজ হয়ে যাচ্ছে তরুণরা। এদের বেশিরভাগই উচ্চ ও মধ্যবিত্ত পরিবারের শিক্ষিত তরুণ, যারা ইংরেজি মাধ্যমে পড়া শেষ করে দেশের শীর্ষ বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে ভর্তি হয়েছিল। উচ্চ ও মধ্যবিত্তের পাশাপাশি গ্রামের মাদরাসা পড়ুয়া তরুণারও বিভ্রান্ত ধর্মীয় নেতাদের অনুপ্রেরণায় সন্ত্রাসবাদে উদ্বুদ্ধ হয়ে ঘর ছেড়ে মধ্যপ্রাচ্যে পাড়ি জমাচ্ছে। এই সংখ্যা শতাধিক বলে জানিয়েছেন আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর একটি সূত্র। নিখোঁজ হওয়া অনেক তরুণ প্রথমে ভারত হয়ে বিভিন্ন উপায়ে সিরিয়া গিয়ে ইসলামিক স্টেটের হয়ে সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডেও অংশ নিয়েছে। বাকিরা দেশেই সাংগঠনিক সিদ্ধান্তে আত্মগোপনে থেকে একের পর এক জঙ্গি হামলায় অংশ নিচ্ছে।

সম্প্রতি পুলিশের আইজিপি একেএম শহীদুল হক বলেছেন, কারো পরিবার থেকে কেউ নিখোঁজ হলে তার চলাফেরা ও নিত্যদিনের কর্মকাণ্ডসহ বিস্তারিত পুলিশের কাছে জানান। র‌্যাবের মহাপরিচালক বেনজীর আহমেদও বলেছেন, ‘পরিবারের কোনো সদস্য নিখোঁজ থাকলে অযথা ভয় না পেয়ে তা আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে জানান। কারণ তাকে খুঁজে বের করতে পারলে তার ও অন্যদের জীবন বাঁচানো যাবে।’

সম্প্রতি রাজধানীর গুলশানে হলি আর্টিজান রেস্তরাঁয় জঙ্গি হামলায় যেসব তরুণ অংশ নেয়া তারা সবাই ৩ থেকে ৬ মাস ধরে নিখোঁজ ছিল বলে তাদের পরিবারের দাবি। এ সংক্রান্তে পরিবারের সদস্যরা সংশ্লিষ্ট থানায় সাধারণ ডায়েরিও করেছে।

গুলশানে হামলাকারীদের একজন রোহানের বাবা ইমতিয়াজ খান বাবুল’ও জানিয়েছেন, তার ছেলেকে খুঁজতে গিয়ে অনেক তরুণের নিখোঁজ হওয়ার সংবাদ পেয়েছেন বিভিন্ন পরিবার থেকে।

এছাড়া ঈদের দিন কিশোরগঞ্জের শোলাকিয়ার ঈদগাহ মাঠের পাশে যে হামলা হয়েছে সেখানেও অংশ নেয়া এক তরুণ গত চার মাস ধরে নিখোঁজ ছিল তার পরিবারের সদস্যরা দাবি করেছেন। এই দুই ঘটনার পর সন্ত্রাস বাদে উদ্বুদ্ধ হয়ে শিক্ষিত ও উচ্চবিত্ত পরিবারের তরুণদের খুঁজে বের করতে তৎপরতা শুরু করেছে।

সংশ্লিষ্ট সূত্র বলছে, এখন পর্যন্ত শতাধিক তরুণ নিখোঁজ হওয়ার তথ্য তারা পেয়েছেন। যারা সন্ত্রাসবাদে উদ্বুদ্ধ হয়েই ঘর ছেড়েছে বলে গোয়েন্দা কর্মকর্তারা নিশ্চিত হয়েছেন।

গোয়েন্দা সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, সমপ্রতি নিখোঁজ দশ তরুণের বিষয়ে তথ্য পেয়েছেন গোয়েন্দারা।

নিখোঁজ হওয়া এই তরুণরা হলেন- ঢাকার তেজগাঁওয়ের মোহাম্মদ বাসারুজ্জামান, বাড্ডার জুনায়েদ খান (পাসপোর্ট নম্বর-এএফ ৭৪৯৩৩৭৮), চাঁপাইনবাবগঞ্জের নজিবুল্লাহ আনসারী, ঢাকার আশরাফ মোহাম্মদ ইসলাম (পাসপোর্ট নম্বর-৫২৫৮৪১৬২৫), সিলেটের তামিম আহমেদ চৌধুরী (পাসপোর্ট নম্বর-এল ০৬৩৩৪৭৮), ঢাকার ইব্রাহীম হাসান খান (পাসপোর্ট নম্বর-এএফ ৭৪৯৩৩৭৮), লক্ষ্মীপুরের এটিএম তাজউদ্দিন (পাসপোর্ট নম্বর-এফ ০৫৮৫৫৬৮), ঢাকার ধানমণ্ডির জুবায়েদুর রহিম (পাসপোর্ট নম্বর-ই ১০৪৭৭১৯), সিলেটের মোহাম্মদ সাইফুল্লাহ ওজাকি (পাসপোর্ট নম্বর-টিকে ৮০৯৯৮৬০) ও মোহাম্মদপুরের জুন্নুন শিকদার (পাসপোর্ট নম্বর-বিই ০৯৪৯১৭২)। এদের মধ্যে নিখোঁজ জুন্নুন শিকদার জঙ্গিবাদে সম্পৃক্ত থাকার অভিযোগে ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের হাতে একবার গ্রেপ্তার হয়েছিলেন। পরে আদালত থেকে জামিনে বের হয়ে তিনি আত্মগোপনে চলে যান।

আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কর্মকর্তারা বলছেন, এসব তরুণ স্বেচ্ছায় ঘর থেকে বেরিয়ে যাচ্ছেন। আত্মগোপনে থেকে তারা সন্ত্রাসী তৎপরতা চালাচ্ছে। বাড়ি থেকে বেরিয়ে যাওয়ার পর অভিভাবকরা থানা-পুলিশকে জানাচ্ছেন। আর স্বেচ্ছায় ঘর ছাড়া হওয়ার কারণে তাদের খুঁজে বের করাও সম্ভব হচ্ছে না।

গোয়েন্দা পুলিশের একজন কর্মকর্তা জানান, এসব তরুণ একবার বাসা ত্যাগ করার পর আর পরিবারের কারো সঙ্গে যোগাযোগ করে না। এজন্য তাদের খুঁজে বের করাও সম্ভব হচ্ছে না।

সূত্র জানায়, গুলশান ঘটনায় জড়িত সন্ত্রাসবাদে ঝুঁকে পড়া বিপথগ্রস্থ রোহান ইমতিয়াজ নিখোঁজ হন গত বছরের ৩০শে ডিসেম্বর। চলতি বছরের শুরুতে নিবরাস ইসলাম এবং ২৯শে ফেব্রুয়ারি থেকে নিখোঁজ ছিলেন মীর সামিহ মোবাশ্বের। এ ঘটনায় জড়িত বগুড়ার অন্য দুই জঙ্গি শফিকুল এবং খায়রুলও দীর্ঘসময় ধরে ছিলেন পরিবার থেকে বিচ্ছিন্ন। মাদারীপুরে হিন্দু শিক্ষক হত্যাচেষ্টা ঘটনায় হাতেনাতে গ্রেপ্তার ও পরে পুলিশের সঙ্গে বন্দুকযুদ্ধে নিহত ফাহিমও ঘটনার তিন দিন আগে বাসা থেকে কাউকে কিছু না বলে বেরিয়ে যায়। তার বাবাও থানায় নিখোঁজের জিডি দায়ের করেছিলেন।

পুলিশ সূত্র জানায়, নিখোঁজ তরুণদের অবস্থান শনাক্ত করতে বহুমুখী তৎপরতা শুরু করেছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। পুলিশের পক্ষ থেকে নিখোঁজ তরুণদের সম্পর্কে তথ্য দেয়ার আহ্বানও জানানো হয়েছে। বিশেষ একটি গোয়েন্দা সংস্থার একজন কর্মকর্তা জানান, নিখোঁজ তরুণদের সন্ধান করে তারা জানতে পারেন এদের অনেকেই দেশ ছেড়ে তুরস্ক হয়ে সিরিয়া চলে গেছে। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, নিখোঁজ তরুণদের কেউ কেউ পরিবারের সদস্যদের মোবাইল ফোনে ‘নেটওয়ার্কের বাইরে’ চলে যাওয়ার বার্তাও দিয়েছে। এছাড়া কেউ কেউ পরকালে দেখা হবে বলে চির বিদায় নিয়ে চলে যাচ্ছে।

গোয়েন্দা সংশ্লিষ্ট তথ্য বলছে, বছর দুই আগে থেকে শিক্ষিত ও উচ্চবিত্ত এবং উচ্চ মধ্যবিত্ত তরুণদের নিখোঁজ হওয়ার প্রবণতা বাড়ছে। এসব তরুণ প্রথমে আইএসে যোগদানের জন্য চেষ্টা করেছে। তবে আইএস থেকে নিজ দেশে থেকেই কথিত জিহাদ চালাতে বললে তারা দেশেই জঙ্গি তৎপরতা শুরু করে। সে সময় একটি গোয়েন্দা সংস্থা আইএসে যোগদানে ইচ্ছুক তরুণদের একটি তালিকা তৈরি করেছিল। ওই তালিকায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পিএইচডিরত শিশির, আহসানুল্লাহ বিশ্ববিদ্যালয়ের সিরাজুল, ফৌজদারহাট ক্যাডেট কলেজের সাবেক ছাত্র ফিরোজ, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের মীর ফরিদুল হক, রাজশাহী ক্যাডেট কলেজের সাবেক ছাত্র ও বর্তমানে মেরিন ইঞ্জিনিয়ার নজিবুল্লাহ আনছারী, সিলেট ক্যাডেট কলেজের সাবেক ছাত্র আবু সামির, নাসা গ্রুপের সফটওয়ার সেকশনে কর্মরত ফয়জুল, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের ছাত্র আল ফারুক ওমর শরীফ ওরফে গালিব, একটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী আরহান, মির্জাপুর ক্যাডেট কলেজের সাবেক ছাত্র ও বর্তমানে ইলেকট্রিক্যাল ইঞ্জিনিয়ার হিসেবে একটি পলিটেকনিক ইনস্টিটিউটে লেকচারার হিসেবে কর্মরত সিফাত, কম্পিউটার বিজ্ঞানে অধ্যয়নরত মেহেরুন্নেসা ফেরদৌসি নামে এক তরুণী, উত্তরায় বসবাসরত সফটওয়্যার ইঞ্জিনিয়ার আতিক সরকার, জিম তানভির, চুয়েটের সাবেক ছাত্র কম্পিউটার প্রকৌশলী সৈয়দ সাদ হাসনাইন, মাহমদু রনি, লালমাটিয়া এলাকার একটি ইংলিশ মিডিয়াম স্কুলের কর্ণধার সাকিব, মোজাদ্দিদ, ময়মনসিংহের কামরান, মির্জাপুর ক্যাডেট কলেজের সাবেক ছাত্র ও বর্তমানে প্রকৌশলী সোহান, রাজশাহী ক্যাডেট কলেজের সাবেক ছাত্র ফয়সাল, সিলেট ক্যাডেট কলেজের সাবেক ছাত্র রায়হান প্রমুখ তরুণ ও যুবকের নাম রয়েছে।

সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, এদের অনেকেই সিরিয়ায় গিয়ে আইএসে যোগদান করেছে। বাকিরা দেশেই আত্মগোপনে থেকে আইএসের হয়ে সাংগঠনিক তৎপরতা চালাচ্ছে।

গোয়েন্দা সূত্র জানায়, বছর দেড়েক আগে আমিনুল ইসলাম বেগ নামে এক ব্যক্তিকে আটক করা হয়। সে কোকাকোলার প্রধান আইটি কর্মকর্তা হিসেবে কর্মরত ছিল। বেগ, সাইফুল্লাহ ওরফে আবু মুসা নামে জাপান প্রবাসী একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রভাষক ও আশরার আহমেদ চৌধুরী নামে এক ব্যক্তি মিলে আইএসের সঙ্গে যোগাযোগ করার চেষ্টা করেছে। এদের মধ্যে বেগসহ কয়েকজনকে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী গ্রেপ্তারও করেছিল।

সূত্র জানায়, উচ্চশিক্ষিত এই গ্রুপটি আইএসে সরাসরি যোগ দিতে না পেরে জেএমবির হয়ে উচ্চবিত্ত ও শিক্ষিত তরুণদের মগজ ধোলাই করে নিজেদের দলে ভেড়ানোর চেষ্টা করছে।

সূত্র: মানবজমিন