ক্লাব পাড়া ফাঁকা, যুবলীগের কর্মীদের পাহারায় সম্রাট

যুবলীগ প্রতিষ্ঠিত হয়েছে মানুষের পাশে দাঁড়াতে

নিউজ ডেস্ক : কাকরাইলের রাজমণি সিনেমা হলের সামনে ভূঁইয়া ম্যানশনে শতাধিক যুবকের পাহারা। সামনে সারি সারি মোটরসাইকেল। রাত যত বাড়ে, পাহারারত যুবক ও মোটরসাইকেলের সংখ্যা তত বাড়ে। এসব তরুণ–যুবকের সবাই আওয়ামী যুবলীগের কর্মী। ভূঁইয়া ম্যানশন নামের এই ভবনে বসেন ঢাকা দক্ষিণ যুবলীগের সভাপতি ইসমাইল হোসেন চৌধুরী ওরফে সম্রাট। তাঁকে আগলে রাখতেই অনুগত কর্মীদের এই সমাবেশ।

গতকাল শনিবার বিকেলে সম্রাটের কার্যালয় কর্মীদের ভিড়ে জমজমাট থাকলেও মতিঝিলের ক্লাবপাড়ায় ছিল সুনসান নীরবতা। ক্যাসিনো চালানোর অভিযোগে সিলগালা করে দেওয়া ক্লাবগুলোর সামনে পুলিশি পাহারা। যেসব ক্লাবে অভিযান হয়নি, সেখানেও কেউ নেই। দুই দফায় অভিযানের পর ঢাকার ক্যাসিনোগুলো বন্ধ হয়ে আছে।

খোঁজ নিয়ে দেখা গেছে, মতিঝিলের ক্লাবপাড়ায় মোহামেডান, আরামবাগ, দিলকুশা, ওয়ান্ডারার্স, ভিক্টোরিয়া ও ফকিরাপুল ইয়ংমেনস ক্লাবে ক্যাসিনো ছিল। এর মধ্যে ইয়ংমেনস ক্লাবে ক্যাসিনো চালাতেন ঢাকা মহানগর দক্ষিণ যুবলীগের সাংগঠনিক সম্পাদক খালেদ মাহমুদ ভূঁইয়া। বাকি পাঁচটি ক্লাবে ক্যাসিনো চালাতেন সম্রাটের লোকজন। তবে সম্রাট নিজে সরাসরি ক্যাসিনো দেখাশোনা করতেন না। তাঁর ক্যাসিনো চালাতেন স্বেচ্ছাসেবক লীগের কেন্দ্রীয় সভাপতি মোল্লা মো. আবু কাওসার ও ওয়ার্ড কাউন্সিলর এ কে এম মমিনুল হক ওরফে সাঈদ। তাঁরাই এক বছর আগে পল্টনের প্রীতম–জামান টাওয়ারে ক্যাসিনো চালু করেন। পরে সেটা বন্ধ হয়ে যায়। ক্যাসিনোর দুই হোতা আবু কাওসার ও মমিনুল হক এখন বিদেশে রয়েছেন। সম্রাট বুধবার থেকে নিজের কার্যালয়েই অবস্থান করছেন।

সম্রাটের বক্তব্য জানতে গতকাল কয়েক দফা যোগাযোগ করে তাঁকে পাওয়া যায়নি। তাঁর নম্বরে ফোন করা হলে এক ব্যক্তি ফোন ধরে বলেন, তিনি বিশ্রামে আছেন। এরপর আর কেউ ফোন ধরেননি। তাঁর কার্যালয়ের সামনে গেলে সেখানে থাকা কর্মীরা জানান, অনুমতি ছাড়া ভেতরে যাওয়া যাবে না।

সম্রাটের ব্যাপারে সরকারের অবস্থান জানতে গতকাল সাংবাদিকেরা স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খানকে বলেন, দুর্নীতিসহ বিভিন্ন অপকর্মে যুবলীগ ঢাকা মহানগর দক্ষিণের সভাপতি ইসমাইল হোসেন চৌধুরীর নাম গণমাধ্যমে আসছে। তাঁর বিরুদ্ধেও ব্যবস্থা নেওয়া হবে কি না। জবাবে মন্ত্রী বলেন, ‘যার নাম আপনারা বলছেন, সে ছাড়াও সরকারের অন্য কেউ যদি কোনো অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডে জড়ায়, তাহলে তার বিরুদ্ধেও আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’

ক্যাসিনোবিরোধী অভিযান শুরু হয় গত বুধবার। সরকারের উচ্চপর্যায়ের নির্দেশে ওই দিন মতিঝিলের ইয়ংমেনস, ওয়ান্ডারার্স, মুক্তিযোদ্ধা ক্রীড়া চক্র ও বনানীর গোল্ডেন ঢাকা ক্লাবে অভিযান হয়। মতিঝিলে অভিযানের সময় ইয়ংমেনস ক্লাবের সভাপতি খালেদ মাহমুদকে গুলশানের বাসা থেকে অস্ত্রসহ গ্রেপ্তার করা হয়। শুক্রবার রাতে কলাবাগান ক্রীড়া চক্র ও ধানমন্ডি ক্লাবে অভিযান হয়। কলাবাগানে অভিযানের আগে ক্লাবের সভাপতি শফিকুল আলম ফিরোজকে অস্ত্রসহ গ্রেপ্তার করা হয়। ধানমন্ডি ক্লাবের বার শুক্রবার সিলগালা করে দেয় র‌্যাব।

অনেক ক্লাবের কর্মকর্তারা বলছেন, ভয় দেখিয়ে ক্লাবের জায়গা দখল করে ক্যাসিনো করা হয়েছে। যুবলীগ নেতাদের এ কাজে সহযোগিতা করেছে পুলিশ প্রশাসন। পুলিশি পাহারায় রাতভর ক্যাসিনো চলেছে।

গতকাল ঢাকা মহানগর পুলিশের অপরাধ সভায় এ নিয়ে ক্ষোভ প্রকাশ করেন কমিশনার মোহা. শফিকুল ইসলাম। ডিএমপি সদর দপ্তরে অনুষ্ঠিত সভায় তিনি বলেন, অবৈধ ক্যাসিনো পুলিশের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন করেছে। এর হাত থেকে রক্ষা পেতে অবৈধ ক্যাসিনোর বিরুদ্ধে অভিযান অব্যাহত রাখতে হবে।

সরকারের একাধিক দায়িত্বশীল সূত্র জানিয়েছে, জুয়া বা ক্যাসিনো বন্ধে অভিযান অব্যাহত থাকবে। শুধু ক্যাসিনো নয়, বিভিন্ন সেক্টরে এই অভিযান চলবে। সরকারের প্রভাব খাটিয়ে যারা অন্যায় কাজে জড়িত, তাদের বিরুদ্ধে শক্ত ব্যবস্থা নেওয়া হবে।

ক্লাবপাড়ার একাধিক সূত্র বলেছে, ফকিরাপুল ইয়ংমেনস ক্লাবও যুবলীগের প্রভাব খাটিয়ে দখল করেছিলেন খালেদ মাহমুদ। এই ক্লাবের সভাপতি ছিলেন মতিঝিল থানা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক নাসির উদ্দিন। তাঁকে হটিয়ে খালেদ অনেকটা জোর করে ক্লাবের দায়িত্ব নিয়ে ক্যাসিনো চালাতে শুরু করেন।

আরামবাগ ও দিলকুশা ক্লাবের চরিত্র একই রকম। সরকার বদলের পর এই দুটি ক্লাবেরই সভাপতি হন আওয়ামী লীগের স্থানীয় ওয়ার্ড কাউন্সিলর ঢাকা মহানগর দক্ষিণ যুবলীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মমিনুল হক। তিনি অন্তত পাঁচটি ক্লাবের সঙ্গে সরাসরি যুক্ত। তিনি ইসমাইল হোসেন চৌধুরীর‍ ঘনিষ্ঠ লোক বলে পরিচিত। তবে আরামবাগ ক্লাবে ক্যাসিনো চালাতেন পুরান ঢাকার ব্যবসায়ী শাহাজাদুল ইসলাম। ২০০৯ সালে জুয়া বন্ধে প্রতিবন্ধকতা সরাতে তিনি হাইকোর্টে রিট করেছিলেন।

ক্যাসিনোর কারণে বন্ধ হওয়া আরেক ক্লাব ঢাকা ওয়ান্ডারার্সের সভাপতি কেন্দ্রীয় স্বেচ্ছাসেবক লীগের সভাপতি মোল্লা আবু কায়সার। ক্লাবপাড়ার লোকেরা বলেন, ওয়ান্ডারার্স ডুবেছে ক্যাসিনোয়। এই ক্লাবে ক্যাসিনো চালান রশিদুল হক। তিনিও ২০১০ সালে জুয়া বন্ধে প্রতিবন্ধকতা সরাতে হাইকোর্টে রিট করেছিলেন।

ভিক্টোরিয়া ক্লাবে ক্যাসিনো চালাতেন কাশেম নামের এক ব্যবসায়ী। মোহামেডান স্পোর্টিংয়ের ডিরেক্টর ইনচার্জ লোকমান হোসেন ভূঁইয়া ক্লাব চালান। অভিযোগ আছে, তাঁকে চাপের মুখে ফেলে মমিনুল হক সেখানে ক্যাসিনো চালু করেন। তিনি এর প্রতিবাদ করেও সুফল পাননি।

এদিকে অভিযানের পর সব কটি ক্লাবই বন্ধ দেখা গেছে। ক্লাবের বেশির ভাগ কর্মকর্তা ফোন বন্ধ করে গা ঢাকা দিয়েছেন। আবার যেসব ক্লাব খোলা ছিল, সেখানকার কর্মকর্তারা কথা বলতে চাননি।

কলাবাগান ক্লাবে অভিযানের পর গতকাল ক্লাবটি সারা দিন বন্ধ দেখা যায়। সন্ধ্যায় ক্লাবের সামনে একজন কেয়ারটেকারকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখা যায়। অন্যান্য দিন ক্লাবে লোকজন এলেও গতকাল সেখানে কেউ আসেনি।

ধানমন্ডি ক্লাবে শুক্রবার রাতে অভিযান চালায় র‍্যাব। সেখানে একটি বৈধ বার রয়েছে। বারের গোডাউন গতকাল ২৪ ঘণ্টার জন্য সিলগালা করে দেওয়া হয়। এখনো সেই অবস্থায় আছে।

অবৈধ জুয়ার আসরে কারওয়ান বাজারের প্রগতি ক্লাবে গত শুক্রবার অভিযান চালায় র‍্যাব। ওই দিন বিকেল পাঁচটা থেকে ক্লাবটি ঘিরে রাখে র‍্যাবের একটি দল। তবে এই ক্লাব থেকে জুয়া খেলার অভিযোগে কাউকে আটক করেনি র‍্যাব।

তেজগাঁও বিজি প্রেস মাঠে বিজি প্রেস স্পোর্টিং অ্যান্ড রিক্রিয়েশন ক্লাব নামের একটি ক্লাব রয়েছে। এই ক্লাবে একসময় জুয়া হতো। গতকাল সেখানেও কক্ষগুলো তালাবদ্ধ দেখা যায়। স্থানীয় লোকজন জানান, এখানে জুয়া বন্ধ রয়েছে।

জানতে চাইলে পুলিশের সাবেক মহাপরিদর্শক নূরুল হুদা জানান, ক্যাসিনো-কাণ্ডে যাঁদের নাম আসছে, তাঁদের প্রত্যেকের ব্যাপারেই তদন্ত হওয়া উচিত। বড় ফৌজদারি অপরাধ প্রতিরোধ ও প্রতিকার করা—দুটোই আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কাজ। তাকে অবশ্যই তদন্ত করে কার সম্পৃক্ততা কতটুকু, তা খুঁজে বের করতে হবে। এমনভাবে করতে হবে, যাতে এটা দৃষ্টান্ত হয়ে থাকে।

বিশিষ্ট আইনজীবী শাহদীন মালিক জানিয়েছেন, এটা স্পষ্টতই পুলিশ বাহিনীর দায়িত্ব পালনে অবহেলা। এই অবহেলা অপরাধ সংঘটনে সহায়তা করছে। অহরহ পুলিশের দায়িত্বহীনতা এবং অপরাধের সঙ্গে অনেকের সম্পৃক্ততার কারণে দেশের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবস্থা অত্যন্ত নাজুক। ফলে জনগণের নিরাপত্তাহীনতা চরমে উঠেছে।