ধার করে চলছে ব্যাংক
নিউজ ডেস্ক : ব্যাংকগুলোতে এখন তারল্য সংকট প্রকট আকার ধারণ করেছে। টাকার অভাবে অনেক ব্যাংক চাহিদামতো ঋণ দিতে পারছে না। আবার কোনো কোনো ব্যাংক চাপ সামলাতে অন্য ব্যাংক থেকে ধার করে চলছে। এর মূল কারণ সার্বিকভাবে ব্যাংক খাতের উদ্বৃত্ত তারল্য কমে গেছে। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের প্রকাশিত তথ্য অনুযায়ী গত জুন মাস শেষে ব্যাংক খাতে মোট উদ্বৃত্ত তারল্য কমে ৬০ হাজার ৫০০ কোটি টাকায় দাঁড়িয়েছে। এতে করে বাড়ছে সুদহার। একই সঙ্গে আন্তঃব্যাংক মুদ্রাবাজারে কলমানির সুদহারও গত চার বছরের সর্বোচ্চ পর্যায়ে রয়েছে।
কেন্দ্রীয় ব্যাংক সূত্রে জানা গেছে, নগদ টাকার সংকটের কারণে অনেক ব্যাংকই এখন স্বল্পসময়ের জন্য ধার করে চলছে। এ কারণে আন্তঃব্যাংক মুদ্রাবাজারে কলমানির সুদহার বাড়ছে। গত ২২ আগস্ট থেকে কলমানির রেট সর্বোচ্চ ৫ দশমিক ৫০ শতাংশে রয়েছে। যা গত চার বছরের মধ্যে সর্বোচ্চ। এর আগে সর্বশেষ ২০১৫ সালের অক্টোবরে কলমানির রেট ৫ শতাংশ উপরে ছিল।
সংশ্লিষ্টরা জানান, ব্যাংকগুলোর টাকার লেনদেনে সংকট দেখা দিলে আন্তঃব্যাংক মুদ্রাবাজার অর্থাৎ কলমানি মার্কেট থেকে তারা স্বল্পসময়ের জন্য ধার করে থাকে। টাকার চাহিদা বেশি থাকলে ধার করতে হয় বেশি সুদে। আর চাহিদার চেয়ে সরবরাহ বেশি থাকলে সুদ কম গুনতে হয়। এখন ব্যাংক খাতে নগদ টাকার সংকট রয়েছে তাই কলমানি রেট ঊর্ধ্বমুখী রয়েছে।
এ বিষয়ে ব্যাংকগুলোর প্রধান নির্বাহীদের সংগঠন অ্যাসোসিয়েশন অব ব্যাংকার্স, বাংলাদেশের (এবিবি) চেয়ারম্যান ও ঢাকা ব্যাংকের এমডি সৈয়দ মাহবুবুর রহমান বলেন, নতুন আমানত কম আসছে। আবার ঋণের চাপ রয়েছে। এছাড়া গত কয়েক মাস ধরে সরকারের ঋণ নেয়ার প্রবণতা বেড়েছে। সব মিলিয়ে ব্যাংকগুলোতে নগদ অর্থের সংকট রয়েছে।
তিনি বলেন, নতুন আমানত না আসলে এ সংকট কাটবে না। এমন পরিস্থিতিতে স্বাভাবিকভাবে সুদহার বাড়ছে বলে জানান ব্যাংকের এমডিদের এ নেতা।
বিদ্যমান নিয়মে, ব্যাংকগুলোর সব ধরনের তলবি ও মেয়াদি আমানতের একটি অংশ নগদে এবং ট্রেজারি বিল ও বন্ড কিনে সরকারকে ঋণ দেয়ার মাধ্যমে বিধিবদ্ধ জমা হিসেবে কেন্দ্রীয় ব্যাংকে রাখতে হয়। প্রচলিত ধারার একটি ব্যাংকের বিধিবদ্ধ জমা (এসএলআর) রাখতে হয় আমানতের সাড়ে ১৮ শতাংশ। ইসলামী ব্যাংকগুলোকে রাখতে হয় ১১ শতাংশ। উভয়ধারার ব্যাংকগুলোকে নগদে রাখতে হয় সাড়ে পাঁচ শতাংশ। বিধিবদ্ধ তারল্য সংরক্ষণে অতিরিক্ত অংশ উদ্বৃত্ত তারল্য। এর একটি অংশও বিভিন্ন বন্ডে বিনিয়োগ থাকে। বাকি অংশ ব্যাংকের ঋণযোগ্য তহবিল।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী, চলতি বছরের জুন শেষে ব্যাংকগুলোতে উদ্বৃত্ত তারল্য দাঁড়ায় ৬০ হাজার ৫৪৯ কোটি টাকায়। যা গত ২০১৮ সালের ডিসেম্বর শেষে ছিল ৭৬ হাজার ৩৯৩ কোটি টাকা। এর আগে ২০১৭ সালের ডিসেম্বর শেষে ছিল ৮৬ হাজার ৬৯৬ কোটি টাকা। এর আগে ২০১৬ সাল শেষে ছিল এক লাখ ২২ হাজার ৭৫ কোটি টাকা। ২০১৫ সালের ডিসেম্বর শেষে ছিল এক লাখ ২০ হাজার ৬৭৯ লাখ কোটি টাকা।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অর্থ উপদেষ্টা এ বি মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম বলেন, নানা কেলেঙ্কারির কারণে ব্যাংকের প্রতি সাধারণ মানুষের আস্থা কমেছে। অন্যদিকে ব্যাংকের সুদহারের চেয়ে সঞ্চয়পত্রের সুদের হারের পার্থক্য অনেক। এসব কারণে ব্যাংকগুলো কাঙ্ক্ষিত আমানত পাচ্ছে না। বিতরণ করা ঋণ ঠিকমতো আদায় হচ্ছে না। খেলাপি বাড়ছে। আবার খেলাপির জন্য বাড়তি নিরাপত্তা সঞ্চিতি রাখতে হচ্ছে। সরকারও ঘাটতি মেটাতে এ খাত থেকে বেশি ঋণ করছে। এসব কারণেই ব্যাংকগুলোর তারল্য কমছে। নগদ টাকার সংকটের কারণে অনেক ব্যাংককে ধার করে চলতে হচ্ছে।
এ পরিস্থিতি থেকে উত্তরণের উপায় জানতে চাইলে প্রবীণ এ অর্থনীতিবিদ বলেন, খেলাপিদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে হবে। তাদের কাছে আটকে থাকা ঋণ আদায় করতে হবে। এতে মানুষের আস্থা ফিরবে এবং আমানত সংগ্রহ বাড়বে। এটি না করতে পারলে কোনো লাভ হবে না। পাশাপাশি সরকারের ব্যাংকনির্ভরতা কমাতে হবে।
জানা গেছে, লক্ষ্যমাত্রা অনুযায়ী রাজস্ব আদায় না হওয়ায় উন্নয়ন প্রকল্প বাস্তবায়ন ও ব্যয়নির্বাহ করতে ব্যাংক খাতে ঋণের ওপর সরকারের চাপ বেড়েছে।
কেন্দ্রীয় ব্যাংক সূত্রে জানা গেছে, চলতি অর্থবছরের ১ জুলাই থেকে ৮ আগস্ট পর্যন্ত সরকার ব্যাংক খাত থেকে ঋণ নিয়েছে ২৩ হাজার ৭৬১ কোটি টাকা। এর মধ্যে বাংলাদেশ ব্যাংক দিয়েছে ছয় হাজার ৪৩৯ কোটি টাকা; আর বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলো দিয়েছে ১৭ হাজার ৩২৩ কোটি টাকা। সব মিলিয়ে ব্যাংক খাতে সরকারের ঋণস্থিতি দাঁড়িয়েছে এক লাখ ৩১ হাজার ৮৬৬ কোটি টাকা। এর মধ্যে বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোর ৯১ হাজার ৪৮২ কোটি টাকা এবং কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ৪০ হাজার ৩৮৪ কোটি টাকা।
এদিকে সরকারি ঋণ বাড়লেও ভাটা পড়েছে বেসরকারি খাতের ঋণের প্রবৃদ্ধিতে। কয়েক মাস ধরে ধারাবাহিকভাবে কমে জুলাই মাসে বার্ষিক ঋণপ্রবৃদ্ধি ১১ দশমিক ২৯ শতাংশ। এ হার ২০১৩ সালের জুনের পর সর্বনিম্ন। ওই সমেয় ঋণপ্রবৃদ্ধি ছিল ১১ দশমিক শূন্য ৪ শতাংশ। আগের মাস জুনে বেসরকারি খাতে ঋণের প্রবৃদ্ধি ছিল ১১ দশমিক ২৯ শতাংশ। এছাড়া চলতি বছরের জুনের তুলনায় জুলাইয়ে বেসরকারি ঋণ না বেড়ে উল্টো কমে গেছে।