৫০০ বছর ধরে দাঁড়িয়ে আছে দৃষ্টিনন্দন সুরা মসজিদ

৫০০ বছর ধরে দাঁড়িয়ে আছে দৃষ্টিনন্দন সুরা মসজিদ

নিউজ ডেস্ক: বাংলাদেশে মুসলিম স্থাপত্যের এক অনন্য নিদর্শন ‘সুরা মসজিদ’। দেশের উত্তরের জেলা দিনাজপুরের ঘোড়াঘাটে মসজিদটি অবস্থিত। প্রাচীন স্থাপত্যের সাক্ষী এ মসজিদটি প্রায় সাড়ে ৫০০ বছর আগে নির্মিত। ঘোড়াঘাট উপজেলা পরিষদ চত্বর থেকে তিন কিলোমিটার পশ্চিমে হিলি-ঘোড়াঘাট সড়ক ধরে চৌগাছা এলাকায় গেলেই দেখা মিলবে সুরা মসজিদের।

দৃষ্টিনন্দন এ মসজিদটির নির্মাণশৈলী একনজর দেখতে দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে ছুটে আসেন হাজারো পর্যটক। স্থানীয় দর্শনার্থীদের পাশাপাশি আশপাশের জেলা থেকে আসা বিভিন্ন বয়সী মানুষের আনাগোনা থাকে বছরজুড়ে।

সুরা মসজিদের নির্মাণকাল নিয়ে রয়েছে ভিন্ন ভিন্ন মত। কেউ কেউ এ মসজিদকে সৌর মসজিদ বলে ডেকে থাকেন। আবার কেউ বলেন সুরা মসজিদ। কারো কাছে এ মসজিদ শাহ সুজা মসজিদ নামেও পরিচিত। একেকজনের কাছে একেক নামে পরিচিত ঐতিহাসিক এ নির্দশনটি।

স্থানীয়দের মতে, সুর শব্দের অর্থ জিন। শত শত বছর আগে জিনেরা এক রাতে এই মসজিদটি নির্মাণ করেন বলে স্থানীয় অনেকের বিশ্বাস। আবার মসজিদটির কারুকার্য ও স্থাপত্যেশৈলী দেখে কেউ কেউ ধারণা করেন, ১৬ শতকে সুলতানি আমলে হোসেন শাহীর শাসনকালে এটি নির্মাণ করা হয়। এই মসজিদকে আসমানি বা গায়েবি অর্থাৎ লোক চক্ষুর আড়ালে তৈরি হওয়া মসজিদ বলেও দাবি করা হয়। আবার মুরুব্বিরা বলেন, মুঘল আমলে বাংলার সুবেদার শাহ্ সুজা এই মসজিদ নির্মাণ করেন। তাই তারা একে শাহ সুজা মসজিদ বলে ডাকেন।

তবে এর নির্মাণ ও গঠনশৈলী দেখে ধারণা করা যায়, শাহ সুজার ক্ষমতা গ্রহণের অনেক আগে এটি নির্মিত হয়েছে। যেহেতু এই মসজিদটির কোনো শিলালিপি নেই, তাই গঠনশৈলীর ওপর ভিত্তি করে সম্ভাব্য নির্মাণকাল বের করা হয়। স্থাপত্যশৈলী ও নির্মাণের কলাকৌশল পরীক্ষা-নিরীক্ষার মাধ্যমে ধারণা করা হয়, সুলতান হোসেন শাহর আমলের নিদর্শন এটি।
মসজিদটির বাইরের দিকের আয়তন উত্তর-দক্ষিণে ৪০ ফুট এবং পূর্ব-পশ্চিমে ২৬ ফুট। চার ফুট উঁচু মজবুত প্ল্যাটফর্মের ওপর মসজিদের কাঠামো গড়ে উঠেছে। এর প্রধান কক্ষের আয়তন ভেতরে ১৬.১৬ ফুট। প্রধান কক্ষের সঙ্গে যুক্ত আছে ছয় ফুট প্রশস্ত রাস্তা। পুরো মসজিদের দেয়ালে অসংখ্য খোপকাটা মৌলিক টেরাকোটার অলংকরণ, যা এর ইমারতের বাহ্যিক সৌন্দর্যকে বাড়িয়ে দিয়েছে।

সুলতানি আমলের বিরল স্থাপত্য সুরা মসজিদ প্রধানত দুটি অংশে বিভক্ত। নামাজের কক্ষ ও বারান্দা। মসজিদটির ওপরে বর্গাকার এক গম্বুজবিশিষ্ট নামাজ কক্ষ এবং পূর্ব ভাগে ছোট তিন গম্বুজবিশিষ্ট একটি বারান্দা রয়েছে। নামাজের কক্ষের মাপ ৭.৮৪ মিটার বাই ৭.৮৪ মিটার এবং বারান্দার মাপ ৪.৮৪ মিটার লম্বা ও ২.১২ মিটার চওড়া। চুন সুড়কির সাহায্যে ছোট আকৃতির ইট দ্বারা নির্মিত মসজিদের দেয়াল ১.৮০ মিটার প্রশস্ত। নামাজ কক্ষের চার কোণে চারটি ও বারান্দায় দুটি কালো পাথরের মিনার রয়েছে।

মসজিদে প্রবেশের জন্য পূর্ব দিকে তিনটি ও উত্তর দক্ষিণে একটি খিলানকৃত প্রবেশ পথ রয়েছে। বারান্দার উভয় পাশেও একটি করে প্রবেশ পথ রয়েছে। মসজিদের ভেতরে কেবলা দেয়ালে তিনটি সুন্দরভাবে অলংকৃত পাথরের তৈরি অবতল মিহরাব রয়েছে। মসজিদের ইটের সঙ্গে পাথরের ব্যবহার, দেয়ালের মাঝে পাথরের স্তম্ভ, ইটের গাঁথুনি চোখে পড়ার মতো।
এ ছাড়া প্রত্যেক দরজার নিচে চৌকাঠ রয়েছে। সেগুলো পাথরের তৈরি। পূর্ব পাশে মসজিদে প্রবেশের সিঁড়ি আছে। এখানকার কালো ও বেলে পাথর বাংলার পশ্চিম প্রান্তে অবস্থিত রাজমহল থেকে আনা হয়েছে বলে মনে করা হয়।

প্রতিদিন শত শত দর্শনার্থী মসজিদটি দেখার জন্য আসেন। অনেকে নিজেদের বিভিন্ন মানত পূরণ করার জন্য এখানে এসে রান্না করে আশপাশের লোকজনকে খাওয়ান। সংস্কার কাজ করে মসজিদের সৌন্দর্য বাড়াতে পারলে দর্শনার্থীর সংখ্যা আরও বাড়বে বলে মনে করেন স্থানীয়রা।