স্বর্ণ কেনার পরিকল্পনা নেই বাংলাদেশ ব্যাংকের!

নিজস্ব প্রতিবেদক: বিশ্বব্যাপী কেন্দ্রীয় ব্যাংকগুলো ডলারের পরিবর্তে এ বছর স্বর্ণের মজুদ বাড়ানোর উদ্যোগ নিলেও বাংলাদেশ ব্যাংকের এ বিষয়ে কোনো পরিকল্পনা নেই।

কারণ হিসেবে বলা হচ্ছে, প্রাতিষ্ঠানিক ও ব্যক্তি উদ্যোগে বাংলাদেশে স্বর্ণে বিনিয়োগের চর্চা নেই।

এছাড়া আমাদের দেশে স্বর্ণের বিশ্ব বাজারের বিশ্লেষণ পূর্বাভাস দেওয়ারও অভাব রয়েছে।
চলতি বছরের মে মাসে ওয়ার্ল্ড গোল্ড কাউন্সিল পরিচালিত এক জরিপে বলা হয়েছে, বিশ্বব্যাপী কেন্দ্রীয় ব্যাংকগুলো ডলারের পরিবর্তে এ বছর স্বর্ণের মজুদ বাড়ানোর কথা চিন্তা করছে।

জরিপে অংশ নেওয়া ২০ শতাংশ কেন্দ্রীয় ব্যাংক আগামী এক বছর তাদের স্বর্ণের মজুদ বাড়ানোর উদ্যোগ নিয়েছে। ২০১৯ সালে মাত্র ৮ শতাংশ কেন্দ্রীয় ব্যাংক এই জরিপে অংশ নিয়েছিল।

তবে দেশের কেন্দ্রীয় ব্যাংক বাংলাদেশ ব্যাংকেরিএ বিষয়ে কোনো পরিকল্পনা নেই। বাংলাদেশ ব্যাংক বর্তমানে ১৩ দশমিক ৯৬ মেট্রিক টন স্বর্ণ মজুদ রেখেছে, যা বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভের তুলনায় ২ দশমিক ৩৩ শতাংশ। চলতি বছরের ৫ আগস্ট পর্যন্ত দেশে বৈদেশিক মূদ্রার রির্জাভ ৩৭ দশমিক ৪৮ বিলিয়ন ডলার।

কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, প্রাতিষ্ঠানিক ও ব্যক্তি উদ্যোগে বাংলাদেশে স্বর্ণে বিনিয়োগের চর্চা নেই। তাছাড়া আমাদের দেশে স্বর্ণের বিশ্ব বাজারের বিশ্লেষণ পূর্বাভাস দেওয়ার অভাব রয়েছে, যা স্বর্ণের মজুদ বাড়ানোর ক্ষেত্রে বাধা সৃষ্টি করছে।

বাংলাদেশ ব্যাংক বৈদেশিক মূদ্রার রিজার্ভের ৮৫ শতাংশ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের কেন্দ্রীয় ব্যাংক ফেডারেল রিজার্ভ ও অন্যান্য শীর্ষ র‌্যাংকের বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোতে বিনিয়োগ করেছে। সবগুলো পণ্যই মার্কিন ডলারে যুক্ত।

রিজার্ভের বাকি অর্থ যুক্তরাজ্যের পাউন্ড স্টার্লিং, অস্ট্রেলিয়ান ডলার, কানাডিয়ান ডলার, সিঙ্গাপুরী ডলার, চাইনিজ রেনমিনবি এবং জাপানি ইয়েনে বিনিয়োগ করা হয়েছে।

কিন্তু মহামারির কারণে অর্থনৈতিক বিপর্যয় দীর্ঘস্থায়ী হওয়ার আশঙ্কা থাকায় দীর্ঘ সময়ে জন্য একটি সহজ নীতিতে চলার ইঙ্গিত দিয়েছে ফেডারেল রিজার্ভসহ অন্যান্য বড় কেন্দ্রীয় ব্যাংকগুলো।

চলমান মন্দার প্রবণতা ইতিমধ্যে একটি ইঙ্গিত দিয়েছে যে অর্থনীতি পুনরুদ্ধারে ১২ থেকে ২৪ মাস অথবা আরও বেশি সময় নিতে পারে।

সুদের হার কমে গেলেও স্বর্ণ প্রতিযোগিতামূলক ধারায় রয়েছে। দাম কমে গেলেও বিনিয়োগকারী ধরে রাখে, লোকসান হয় না।

ফলে বিনিয়োগকারীরা স্বর্ণের দিকে ঝুঁকছে। মূল্যবান ধাতু হিসেবে নিরাপদ সম্পদটির দাম গত সপ্তাহেও আউন্স প্রতি ২ হাজার ৬৩ ডলার পৌঁছায়। এটি একমাত্র ধাতু যা মুদ্রা হিসেবে মূদ্রণ করা যায় না এবং অর্থনৈতিক সংকটের এই সময়ে মূল্যস্ফীতির মধ্যেও চাহিদা রয়েছে।

১০ বছরের মধ্যে মার্কিন বন্ডে সুদহার কিছুটা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে বুধবার (১২ আগস্ট) স্বর্ণের দাম কিছুটা কমে আউন্স ১ হাজার ৮৬৪ মার্কিন ডলার হলেও দাম ১ দশমিক ৩ শতাংশ বেড়ে এক আউন্স ১ হাজার ৯৩৫ ডলারে দাঁড়ায়।

ওয়ার্ল্ড গোল্ড কাউন্সিলের জরিপে অংশগ্রহণকারীদের ৮৮ শতাংশ বলেছেন, নেতিবাচক সুদের হার রিজার্ভ পরিচালনার সিদ্ধান্তের সঙ্গে সম্পর্কিত।

ভবিষ্যতে সুদের হার শূন্যের কাছাকাছি থাকবে, করোনা ভাইরাস মহামারির কারণে সম্প্রসারণমূলক আর্থিক নীতিগুলোর ধারাবাহিকতার সঙ্গে এই জরিপের মিল রয়েছে।

জরিপে অংশ নেওয়া ৭৯ শতাংশই মনে করেন, স্বর্ণের দাম শীর্ষে ওঠার কারণ চলমান করোনা ভাইরাস সংকট, যা ২০১৯ সালের তুলনায় ৫৯ শতাংশ বেশি।

অপর দিকে ৭৪ শতাংশ অংশগ্রহণকারী বলেছেন, স্বর্ণ মজুদ করার অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ কারণ হচ্ছে, এই ধাতুতে লোকসান হওয়ার ঝুঁকি কম।

২০০৮ সালের আর্থিক সঙ্কটের পর থেকে, যে অর্থের বিপরীতে স্বর্ণ জমা নেই (ফিয়াট) সেই মুদ্রা ব্যবস্থা থেকে সৃষ্ট ঝুঁকি কমাতে বেশ কয়েকটি কেন্দ্রীয় ব্যাংক স্বর্ণের মজুদ বাড়িয়েছে। মন্দার পরে অনেক দেশ সম্পদের বিপুল পরিমাণ সোনার মজুদে বিনিয়োগ করেছে।

একইভাবে বাংলাদেশ ব্যাংকও বৈদেশিক মূদ্রার বিনিয়োগে বৈচিত্র আনতে ২০১০ সালে প্রথমবারের মতো আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল থেকে আনুষ্ঠানিকভাবে ১০ মেট্রিক টন স্বর্ণ কিনেছিল।

কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কর্মকর্তারা বলেছেন, ২০১০ সালের পরে আরও কোনো স্বর্ণ কেনা হয়নি। চলমান সংকটেও স্বর্ণ কেনার কোনো পরিকল্পনা নেই।

এ বিষয়ে গবেষণা প্রতিষ্ঠান পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউট অব বাংলাদেশের (পিআরআই) নির্বাহী পরিচালক ড. আহসান এইচ মনসুর বলেন, চলমান সংকট কাটিয়ে ওঠা পর্যন্ত স্বর্ণের দাম উর্ধমুখী থাকবে। মন্দার সময়ে স্বর্ণকে ‘নিরাপদ আশ্রয়স্থল’ হিসাবে সম্পূর্ণ বিবেচনা করা হয়, কারণ এটি অন্যান্য বিনিয়োগের চেয়ে স্থির।

তিনি আরও বলেন, মার্কিন ডলার আগামী ১৫-২০ বছরের জন্য বিশ্ব বাজারে আধিপত্য করবে। সুতরাং কেন্দ্রীয় ব্যাংককে ধীরে ধীরে ডলার ছেড়ে অন্যান্য পণ্যে বিনিয়োগ স্থানান্তরের জন্য প্রস্তুতি নেওয়া উচিত।

ডলারের সঙ্গে স্বর্ণের ঐতিহ্যগত বিপরীত সর্ম্পক রয়েছে। আমেরিকান মুদ্রাটির দাম কমলেও ধাতুটির দাম বাড়ে। তবে স্বর্ণের বাজারে আগ্রাসী ধাক্কা দেওয়ার কারণ ডলারের দুর্বল হওয়া।

ওয়ার্ল্ড গোল্ড কাউন্সিলের আরেকটি প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, চলতি বছরের প্রথমার্ধে কেন্দ্রীয় ব্যাংকগুলো স্বর্ণ কেনা কমিয়ে দিয়েছিল।

চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে জুন পর্যন্ত কেন্দ্রীয় ব্যাংকগুলো ২৩৩ দশমিক ৪ মেট্রিক টন স্বর্ণ ক্রয় করেছে, যা আগের বছরের একই সময়ের চেয়ে ৩৯শতাংশ কম। দশ বছরের ৬ শতাংশ বা ২৪৭ মেট্রিক টন কম।

বিশ্বের কেন্দ্রীয় ব্যাংকগুলো গতবছরের প্রথম ছয়মাসে ৩৮৫ দশমিক ৭ মেট্রিক স্বর্ণ ক্রয় করেছিল।