সাইবার ক্রাইম এখন ব্যাংকিং সেক্টরে

নিউজ ডেস্ক:ব্যাংকিং সেক্টরে সাইবার হামলাশুরুর দিকে অনলাইনে অশ্লীল ছবি বা ভিডিও প্রকাশ এবং প্রকাশের হুমকির মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল সাইবার অপরাধ। অ্যাপস-নির্ভর মোবাইল ব্যাংকিং ও অনলাইন ব্যাংকিং চালু হওয়ার পর সাইবার অপরাধ নতুন মাত্রা পেয়েছে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।

তবে সাইবার অপরাধ দমনে কঠোর আইন আছে। কিন্তু এ আইন সম্পর্কে তেমন একটা জানেন না প্রতারিতরা। প্রযুক্তি সম্পর্কেও সচেতন নন তারা। অপরাধ ও সমাজবিজ্ঞানীদের মত এমনটাই।

প্রযুক্তিনির্ভর জালিয়াতি: ব্যাংকিং খাতের প্রযুক্তিনির্ভর ৫০টি জালিয়াতির ঘটনা বিশ্লেষণ করে তৈরি বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব ব্যাংক ম্যানেজমেন্টের (বিআইবিএম) এক গবেষণা প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, প্রযুক্তিভিত্তিক ব্যাংকিং জালিয়াতির ঘটনা সবচেয়ে বেশি ঘটছে এটিএম ও প্লাস্টিক কার্ডের মাধ্যমে। প্রায় ৪৩ শতাংশ জালিয়াতির ঘটনা প্রযুক্তিভিত্তিক। জালিয়াতির ঘটনার মধ্যে ২৫ শতাংশ মোবাইল ব্যাংকিংয়ের মাধ্যমে ঘটছে। অনলাইন চেক ক্লিয়ারিং (এসপিএস) ও ইলেকট্রনিক ফান্ড ট্রান্সফারের (ইএফটি) মাধ্যমে ঘটছে ১৫ শতাংশ। ইন্টারনেট ব্যাংকিংয়ে ১২ শতাংশ, ব্যাংকিং সফ্টওয়ারের মাধ্যমে ৩ শতাংশ এবং সুইফটের মাধ্যমে ২ শতাংশ জালিয়াতির ঘটনা ঘটে।

আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর তথ্য বলছে, অনলাইন ব্যাংকিং প্রতারণার ঘটনায় দেশের বিভিন্ন থানায় ৩০৭টি মামলা আছে। এর মধ্যে অনলাইন ব্যাংকিং প্রতারণার ঘটনায় ১৭২টি এবং মোবাইল ব্যাংকিংয়ের প্রতারণা নিয়ে ১৩৫টি মামলা দায়ের হয়। অনলাইন ব্যাংকিং প্রতারণার সঙ্গে জড়িত থাকা বিভিন্ন সময়ে গ্রেফতার হয়েছে ৮২ জন। আর মোবাইল ব্যাংকিং প্রতারণার অভিযোগে গ্রেফতার হয় ৩৭৪ জন।

অর্থনীতিবিদ ড. মুহম্মদ মাহবুব আলী বলেন, ‘‌দিন দিন ঝুঁকি বাড়ছে। এ খাতের ওপর যেসব আক্রমণ হচ্ছে তা জটিল। কারিগরি ও প্রযুক্তিগত উৎকর্ষতার সঙ্গে সঙ্গে জালিয়াতি প্রতিরোধে ব্যবস্থাও শক্তিশালী করা জরুরি।’

বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব ডেভেলপমেন্ট স্টাডিজের (বিআইডিএস) সিনিয়র ফেলো ড. নাজনীন আহমেদ বলেন, ‘প্রযুক্তিনির্ভর প্রতারণা বা অপরাধের বিষয়ে গ্রাহককে অবশ্যই সচেতন হতে হবে। তবে এই অপরাধ প্রতিরোধে সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠান ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর প্রস্তুতি থাকতে হবে। প্রযুক্তির সুরক্ষা ও অপরাধ প্রতিরোধের দায়িত্ব তাদের ওপরই বর্তায়।’

ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) জনসংযোগ শাখার উপকমিশনার (ডিসি) মাসুদুর রহমান বলেন, ‘দেশে সাইবার অপরাধের প্রধান ক্ষেত্র সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ও মোবাইল ফোনকেন্দ্রিক অপরাধ বাড়ছে। সাইবার অপরাধীদের মোকাবিলায় প্রযুক্তিনির্ভর পুলিশিং ব্যবস্থা এগিয়ে নেওয়া হচ্ছে।’ তিনি বলেন, ‘শুরুতে অনলাইনে অশ্লীল ছবি প্রকাশের হুমকি দেওয়ার মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল সাইবার অপরাধ। মোবাইল ও অনলাইন ব্যাংকিং চালু হওয়ার পর সাইবার অপরাধ নতুন রূপ পেয়েছে। প্রতারিত হচ্ছে অনেক গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠান।’

সাইবার প্রতারণা বা অপরাধ নিয়ে কঠোর আইন আছে জানিয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজবিজ্ঞান অনুষদের অধ্যাপক সাদেকা হালিম বলেন, ‘আইন আছে, কিন্তু আইন প্রতারিত ব্যক্তিদের সেভাবে রক্ষা করতে পারছে না। কারণ, তারা আইন ও প্রযুক্তি সম্পর্কে সেভাবে সচেতন না।’ তিনি বলেন, সাইবার অপরাধ নিয়ে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়, ডাক ও টেলিযোগাযোগ মন্ত্রণালয় এবং আইসিটি বিভাগ কাজ করছে। কিন্তু কেউ কারও সঙ্গে সমন্বয় করছে না, সমন্বয় জরুরি।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে অপরাধ বিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ড. জিয়া রহমান বলেন, ‘প্রযুক্তিনির্ভর এই অপরাধ মোকাবিলায় সরকার ও পুলিশ প্রশাসনকে নতুন পরিকল্পনা নিয়ে এগোতে হবে। মাদক, সন্ত্রাস ও জঙ্গিবাদ দমনে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী জোরালো ভূমিকা রাখছে। সাইবার অপরাধ দমনেও ভূমিকা জোরালো করতে হবে। সাইবার অপরাধ বন্ধে সচেতনতাই মূল ভূমিকা রাখতে পারে।’ নিজের ভার্চুয়াল জগৎ নিজের নিয়ন্ত্রণে রাখা খুবই গুরুত্বপূর্ণ বলেও মন্তব্য করেন তিনি।

দেশের শীর্ষ মোবাইল ব্যাংকিং সেবাদাতা প্রতিষ্ঠান বিকাশের হেড অব করপোরেট কমিউনিকেশন্স শামসুদ্দিন হায়দার ডালিম বলেন, ‘‌সচেতনতার অভাবে গ্রাহকরা প্রতারিত হন। গ্রাহকদের সচেতন করতে নানা কর্মসূচি নেওয়া হয়েছে।’

আইন কী বলে:

বাংলাদেশে ২০০৬ সালে প্রথম সাইবার অপরাধ প্রতিরোধ আইন (আইসিটি অ্যাক্ট) প্রণয়ন হয়। ২০১৩ সালে এই আইন সংশোধন করে সরকার। ওই বছরই ঢাকায় স্থাপন হয় দেশের একমাত্র সাইবার ট্রাইব্যুনাল।

আইনের ৫৪ ধারা অনুযায়ী, কম্পিউটার বা কম্পিউটার সিস্টেমের ক্ষতি, অনিষ্টসাধন যেমন, ই-মেইল পাঠানো, ভাইরাস ছড়ানো, সিস্টেমে অনধিকার প্রবেশ বা সিস্টেমের ক্ষতি করা অপরাধ। এর শাস্তি সর্বোচ্চ ১৪ বছর কারাদণ্ড এবং সর্বনিম্ন ৭ বছর কারাদণ্ড বা ১০ লাখ টাকা পর্যন্ত জরিমানা।

৫৬ ধারা অনুযায়ী, কেউ যদি ক্ষতি করার উদ্দেশে এমন কোনও কাজ করেন, যার ফলে কোনও কম্পিউটার রিসোর্সের কোনও তথ্য বিনাশ, বাতিল বা পরিবর্তন হয় বা এর উপযোগিতা হ্রাস পায় অথবা কোনও কম্পিউটার, সার্ভার, নেটওয়ার্ক বা কোনও ইলেকট্রনিক সিস্টেমে অবৈধভাবে প্রবেশ করেন, তবে এটি হবে হ্যাকিং অপরাধ। যার শাস্তি সর্বোচ্চ ১৪ বছর কারাদণ্ড এবং সর্বনিম্ন ৭ বছর কারাদণ্ড বা এক কোটি টাকা পর্যন্ত জরিমানা।

৫৭ ধারা অনুযায়ী, কোনও ব্যক্তি যদি ইচ্ছাকৃতভাবে ওয়েবসাইটে বা অন্য কোনও ইলেকট্রনিক বিন্যাসে কোনও মিথ্যা বা অশ্লীল কিছু প্রকাশ বা সম্প্রচার করেন, যার দ্বারা মানহানি ঘটে, আইনশৃঙ্খলার অবনতি হয় অথবা রাষ্ট্র বা ব্যক্তির ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন হয়, তাহলে এগুলো হবে অপরাধ। এর শাস্তি সর্বোচ্চ ১৪ বছর কারাদণ্ড এবং সর্বনিম্ন ৭ বছর কারাদণ্ড এবং এক কোটি টাকা পর্যন্ত জরিমানা।

সাইবার অপরাধ প্রতিরোধ আইনে দায়ের হওয়া মামলার ৯০ ভাগই দায়ের হয়েছে আইনের ৫৭ ধারায়।

ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন ও পরিবর্তিত পরিস্থিতি:

গত বছরের ১৯ সেপ্টেম্বর জাতীয় সংসদে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন পাস হওয়ার আগপর্যন্ত তথ্যপ্রযুক্তি সংক্রান্ত অপরাধের ঘটনায় সাইবার অপরাধ প্রতিরোধ আইনেই (আইসিটি অ্যাক্ট) সব মামলা দায়ের হয়েছে।

বর্তমানে সাইবার অপরাধের ঘটনায় ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের ১৭, ১৮, ১৯, ২০, ২১, ২৫, ২৭, ২৮, ২৯, ৩০, ৩২ ও ৩৪ ধারায় মামলা হচ্ছে। এই ধারাগুলোর সঙ্গে সাইবার অপরাধ প্রতিরোধ আইনের (আইসিটি অ্যাক্ট) বিভিন্ন ধারার মিল আছে।

ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের অপরাধ ও শাস্তি সংক্রান্ত ২০টি ধারার মধ্যে ১৪টি জামিন অযোগ্য, পাঁচটি জামিনযোগ্য ও একটি সমঝোতা সাপেক্ষ। ন্যূনতম শাস্তির মেয়াদ এক বছর। আর সর্বোচ্চ শাস্তি যাবজ্জীবন কারাদণ্ড। অধিকাংশ ক্ষেত্রে শাস্তির মেয়াদ ৪ থেকে ৭ বছরের জেল।