সময় এসেছে তুরস্ককে সঠিক মূল্যায়ন করার!

সময় এসেছে তুরস্ককে সঠিক মূল্যায়ন করার!

পশ্চিমা শক্তি যখন উসমানীয় সাম্রাজ্য ধ্বংসের খেলায় মত্ত তখন ইউরোপের পত্রিকাগুলো উসমানীয়দের তথা তুরস্ককে ‘রুগ্ন মানুষ’ হিসেবে দেখতে ব্যস্ত ছিল।

‘ইউরোপের রুগ্ন মানুষ’ শিরোনামে দিনের পর দিন উসমানীয় সুলতানের ব্যঙ্গ চিত্র চাপিয়েছে ফ্রান্স, ব্রিটেনসহ বিভিন্ন দেশের পত্রিকা। সেই যে ট্যাগ লাগানো হলো প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময়ে তারপর থেকেই তুরস্ক কখনই এই ট্যাগ থেকে মুক্ত হতে পারেনি।

সামরিক শক্তি, অর্থনীতি এবং রাজনৈতিক দিক দিয়ে ইউরোপের বহু দেশের চেয়ে ঢের শক্তিশালী হওয়া সত্ত্বেও তুরস্কের ঘারে চাপিয়ে দেওয়া এই কালো ব্যাজ বহন করতে হয়েছে প্রায় একশো বছর। আমাদের দেশের কোমলমতি ছাত্র-ছাত্রীদের মনেও সূক্ষ্মভাবে ঢুকিয়ে দেয়ায় হয়েছিল এ ম্যাসেজটি। আমরাও মুখস্ত করেছি ‘তুরস্ককে বলা হয় ইউরোপের রুগ্ন মানুষ’।

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে তুরস্ক নিরপেক্ষ ছিল, তারপর থেকেই ন্যাটোর সদস্য, ইউরোপীয় ইউনিয়নের সদস্য পদের আবেদন করেছিল কয়েক দশক আগে থেকেই, নাটোর দ্বিতীয় বৃহত্তম সামরিক শক্তি আজকে থেকে নয়, সাইপ্রাসে গ্রিস সেনাবাহিনীর গণহত্যা রুখতে সেনা অভিযান চালিয়ে অর্ধেক দখল করেছিল সেই ১৯৭৪ সালে। কিন্তু তারপরও মুছেনি ওই কালো ট্যাগ। কিন্তু গত দুই দশক ধরে তুরস্ক তার হারানো ঐতিহ্য ফিরে পেতে অক্লান্ত প্রচেষ্টা করেছে।

একদিক দিয়ে সামরিক শক্তি বৃদ্ধি করছে, অন্যদিক দিয়ে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে নিজের অবস্থান শক্ত করছে। দেশের ভেতরে রাস্তাঘাট অবকাঠামো স্বাস্থ্য চিকিৎসাসহ সার্বিক উন্নয়নে মনোবিবেশ করেছে। একই সঙ্গে মজলুম, অত্যাচারিত, নিপীড়িত অসহায় মানুষের পাশে দাঁড়িয়েছে। অর্থ দিয়ে, শক্তি দিয়ে, সাহস জুগিয়ে, সান্ত্বনা দিয়ে অসহায় মানুষের পাশে দাঁড়িয়েছে। তাদের পক্ষ নিয়ে দাঁড়িয়েছে বিশ্বের দরবারে। নিপীড়িতদের পক্ষ নিয়ে সারা বিশ্বের সামনে হুঙ্কার দিয়েছে।

এজন্য অবশ্য অনেক লাঞ্ছনা, গঞ্জনা, মিথ্যা অপবাদ, কূটনৈতিক শিষ্টাচার বহির্ভূত অনেক আন্তর্জাতিক চাপের মুখোমুখি হতে হয়েছে তুরস্ককে। কিন্তু সবকিছুর পরেও এগিয়ে চলছে।

পশ্চিমাদের হুমকি ধামকি আর চাপ, আরব বিশ্বের হীনমন্যতা আর অবিশ্বাস, মুসলিম বিশ্বের পশ্চিমা ভীতির কারণে তুরস্কের পক্ষে সাহস করে কেউ কথা বলছে না।

তবে সবাই বুঝতে পারছে এই তুরস্ক প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময়ের তুরস্ক নয়। এই তুরস্ক দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়ের তুরস্ক নয়। এই তুরস্ক ঠাণ্ডা যুদ্ধের সময়ের তুরস্ক নয়। এমনকি বিশ বছর আগের তুরস্কও নয়।

আজকের তুরস্ক মুসলিম বিশ্বের নেতৃত্ব দেয়ার যোগ্যতা রাখে। ককেশাস, মধ্য এশিয়া, বলকান, মধ্যপ্রাচ এবং আফ্রিকায় কোনো কিছু করতে হলে তুরস্কের উপস্থিতি মেনে নিয়েই করতে হবে। সমরে এবং টেবিলে সমান তালে নিজের জানান দিয়ে যাচ্ছে তুরস্ক।

সিরিয়া, ইরাক, ফিলিস্তিন, কাতার, সোমালিয়া, লিবিয়া আর আজারবাইজানের ঘটনা তো সবাই জানে। তুরস্কের সামরিক এবং কূটনৈতিক চাল এই দেশগুলোর ভাগ্যের মোড় ঘুরিয়ে দিয়েছে। এছাড়াও আফ্রিকার দেশ গাম্বিয়া, তিউনিশিয়া, আলজেরিয়া, কঙ্গো, নাইজারসহ আরো কিছু দেশের সাথে তুরস্কের ক্রমবর্ধমান সম্পর্ক ফ্রান্সসহ অনেক পশ্চিমা দেশই ভালোভাবে নিচ্ছে না। নেবেই বা কেন? বছরের পর বছর ধরে আফ্রিকার প্রতি ইঞ্চি ইঞ্চি যারা বিনা বাধায় বিনা দ্বিধায় শুষে শুষে খাচ্ছিল আজ তারা প্রতিরোধের সম্মুখীন হচ্ছে।

যাইহোক, মুসলিম বিশ্বে সৌদি আরব লক্ষ লক্ষ কোটি টাকা বিলিয়েও যে প্রভাব বিস্তার করতে পারেনি, ইরান শত পন্থা অবলম্বন করেও মানুষের মন জয় করতে পারেনি; তুরস্ক সেখানে তার ভালোবাসা, মমতা, স্নেহ, সহযোগিতা দিয়ে সারা মুসলিম বিশ্বে সাধারণ মানুষের মন জয় করে নিয়েছে।

আজ ককেশাসের পাহাড়ে, সাহারার মরুভূমিতে, আফ্রিকার জঙ্গলে, উপসাগরীয় অট্টালিকায়, দক্ষিণ এশিয়ার মাটির ঘরে প্রশান্ত মহাসাগরের দ্বীপগুলোতে যদি তুরস্কের জন্য মানুষের মন কাঁদে; তাহলে ধরে নিতে হবে তুরস্ক ওই অঞ্চলের মানুষের মন জয় করে নিয়েছে।

আজ তুরস্ক যদি পরাশক্তির বিরুদ্ধে পায়ে খামি দিয়ে দাঁড়িয়ে থাকতে পারে তাহলে বুঝতে হবে তুরস্কের সামরিক শক্তি ফেলে দেয়ার মতো নয়। আজ তুরস্ক যদি শত চাপের পরেও তার অর্থনীতি নিয়ে এগিয়ে যেতে পারে তাহলে বুঝতে হবে তুরস্ক এত ভঙ্গুর নয়।

আজ তুরস্ক যদি তার বন্ধু রাষ্ট্রের পাশে দাঁড়িয়ে তাদেরকে বিজয় এনে দিতে পারে (যেমন আজারবাইজান, কাতার, লিবিয়া, সোমালিয়া, পাকিস্তান) তাহলে বুঝতে হবে তুরস্কের সঙ্গে বন্ধুত্ব শুধু তাসের ঘর নয়।
পশ্চিমাদেরও এখন বুঝতে হবে, তুরস্ককে ব্ল্যাকমেইল করে, কায়দায় ফেলে, হুমকি ধামকি দিয়ে, বশে এনে, কব্জা করে, হুকুমের গোলামীতে চালানোর দিন শেষ।
তুরস্ককে আলোচনার টেবিলের বাইরে রেখে নয় বরং আলোচনার টেবিলে রেখেই, তুরস্কের সাথে সমঝোতায় এসে, সমান-সমান গুরুত্ত্ব দিয়ে চলার সময় এসেছে।
তুরস্ককে অবমূল্যায়ন করার দিন শেষ। সময় এসেছে তুরস্ককে সঠিকভাবে মূল্যায়ন করার।

লেখক: সরোয়ার আলম