প্রতি বছর ক্ষয় হয়ে যায় ঢাকা শহরের সমান আয়তনের ভূমি

ডেস্ক: ধারণার চেয়েও দ্রুত গতিতে বাংলাদেশে ভূমিক্ষয় ঘটছে যা দেশের খাদ্য নিরাপত্তাকে হুমকির মুখে ফেলছে।

প্রতি বছর প্রায় ২৭০ বর্গকিলোমিটার এলাকার মাটির ভৌত, রাসায়নিক, জৈবিক বা অর্থনৈতিক যে বৈশিষ্ট্য তা হ্রাস পাচ্ছে। যা মোটামুটি ঢাকা শহরের আয়তনের সমান।

পরিবেশ অধিদপ্তরের মৃত্তিকা সম্পদ উন্নয়ন ইনস্টিটিউটের (এসআরডিআই) প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা আমীর মুহম্মদ জাহিদ মনে করেন, এ ধারা চলতে থাকলে আগামী ৬৩ বছরের মধ্যে চাষযোগ্য কোনো জমি থাকবে না।



এসআরডিআইর এক সমীক্ষায় দেখা যায়, মাটির অবক্ষয়ের প্রবণতা গত ২০ বছর ধরে অব্যাহত আছে।

আজ বিশ্ব পরিবেশ দিবস। দিবসটির এবারের প্রতিপাদ্য ‘করবো ভূমি পুনরুদ্ধার, রুখবো মরুময়তা’।

আমীর মুহম্মদ জাহিদ সংবাদ মাধ্যমকে বলেন, ভূমির অবক্ষয় রোধে এখনই ব্যবস্থা না নিলে দেশের খাদ্য নিরাপত্তা হুমকির মুখে পড়বে।

আন্তর্জাতিক যোগাযোগের একটি বিশেষ মাধ্যম সিরাতুল মুস্তাকিম

মাটির উর্বরতা হ্রাস, জৈব পদার্থ হ্রাস, অম্লকরণ, লবণাক্ততা, মাটি দূষণ, মাটির ক্ষয়, নদী তীর ভাঙা, বালু ওভারওয়াশ, খরা, জলাবদ্ধতা, সয়েল সিলিং এবং বাস্তুতন্ত্রের অবক্ষয়কে ভূমি অবক্ষয় বলা হয়।

‘ল্যান্ড ডিগ্রেডেশন ইন বাংলাদেশ ২০২০’ শীর্ষক এসআরডিআই গবেষণায় দেখা গেছে, ২০২০ সালে ১ কোটি ১২৪ লাখ হেক্টর জমিতে মাঝারি থেকে অতি মারাত্মক মাত্রার ভূমি অবক্ষয় ঘটেছে। গবেষণাটি ২০২২ সালে প্রকাশিত হয়।

প্রতিবেদনে বলা হয়, এই আয়তন দেশের প্রায় ৭৬ দশমিক ২ শতাংশ। ক্ষয়ে যাওয়া ভূমি ২০০০ সালের ১০ দশমিক ৭০ মিলিয়ন হেক্টর পূর্বানুমানের চেয়ে শূন্য দশমিক ৫৪ মিলিয়ন হেক্টর বেশি।

বিশেষজ্ঞরা বলেছেন, দুর্বল মাটি দেশের কৃষি এবং পরিবেশের ওপর সরাসরি প্রভাব ফেলে।

তারা বলেন, রাসায়নিক সারের অত্যধিক ব্যবহার, লবণাক্ততা বৃদ্ধি, শিল্প দূষণ, বন উজাড় এবং ইলেকট্রনিক ও চিকিৎসা বর্জ্য সঠিকভাবে ডাম্পিং না হওয়ার কারণে দেশের মাটি নষ্ট হচ্ছে।

মাটির অবক্ষয়ের জন্য জনসংখ্যা বৃদ্ধি, তাপমাত্রা বৃদ্ধি এবং অতিরিক্ত চাষাবাদকেও দায়ী করছেন বিশেষজ্ঞরা।

দেশের উত্তরাঞ্চলের বরেন্দ্র অঞ্চল পানি সংকটের কারণে মরুকরণের ঝুঁকিতে পড়ছে, অন্যদিকে দক্ষিণের উপকূলীয় অঞ্চল মারাত্মক লবণাক্ততার ঝুঁকিতে আছে।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মৃত্তিকা, পানি ও পরিবেশ বিভাগের অধ্যাপক ও চেয়ারম্যান মো. হারুন অর রশিদ খান বলেন, আমরা নাজুক পরিস্থিতির মধ্যে আছি। কম বৃষ্টিপাত এবং ভূগর্ভস্থ পানি কমে যাওয়ার কারণে আমরা বাংলাদেশে খরা এলাকা বেড়ে যাওয়ার প্রবণতা দেখতে পাচ্ছি।

তিনি বলেন, মনুষ্যসৃষ্ট দুর্যোগ ছাড়াও বাংলাদেশ ঘূর্ণিঝড়, বন্যা ও তাপমাত্রা বৃদ্ধির মতো জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবও প্রত্যক্ষ করছে।

মাত্রাতিরিক্ত সার ব্যবহারের কারণে মাটিতে উপকারী অণুজীব দ্রুত হ্রাস পাচ্ছে। গাছপালা মাটি থেকে প্রয়োজনীয় পুষ্টি পাচ্ছে না। অতিরিক্ত সার ব্যবহারের পরও কিছু গাছের বৃদ্ধি হচ্ছে না বলে জানান তিনি।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, মাটি প্রাকৃতিকভাবে ক্ষয়প্রাপ্ত ও নিষ্ক্রিয় হয়। কিন্তু গত ৫০ বছরে মানুষ এবং জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে মাটির নিষ্ক্রিয়করণ সেভাবে ঘটেনি।

তারা বলছেন, সারাবছর ক্রমাগত কৃষি কাজের কারণে মাটি বিশ্রাম পাচ্ছে না। সেইঙ্গে উচ্চ ফলনশীল ফসল উৎপাদনের কারণে মাটির ওপর বাড়তি চাপ তৈরি হচ্ছে।

শেরেবাংলা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের মৃত্তিকা বিজ্ঞান বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ড. এ এস এম ফজলে বারী বলেন, মাটির স্বাস্থ্যের ওপর নির্ভর করে আমাদের খাদ্য উৎপাদন। সারাবছর ফসল উৎপাদনে ভূমি ব্যবহার হচ্ছে, ব্যবহার হচ্ছে রাসায়নিক সার ও কীটনাশক। এতে ক্ষতি হচ্ছে মাটির দরকারি অনুজীবের। বাংলাদেশে জমির অভাব একটা বড় সমস্যা আর তাতে দ্বিগুণ কষাঘাত হচ্ছে মাটির অবক্ষয়।

এদিকে সরকার ২০৩০ সালের মধ্যে ২ হাজার বর্গকিলোমিটার জমির উর্বরতা বৃদ্ধির লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করেছে।

পরিবেশ মন্ত্রী সাবের হোসেন চৌধুরী বলেছেন, যেসব জোনে ভূমি ক্ষয় হয়েছে সেগুলো আমরা চিহ্নিত করেছি। ভূমি অবক্ষয়ের গুরুত্বপূর্ণ সমস্যা সমাধানের জন্য আমরা অঞ্চল-নির্দিষ্ট প্রকল্প গ্রহণ করব এবং এফএও (খাদ্য ও কৃষি সংস্থা) আমাদের সহযোগিতা করছে। এ ছাড়া এ সমস্যা সমাধানে প্রকল্প গ্রহণের পরিকল্পনাও করছে সরকার।

তিনি বলেন, ২৩ লাখ হেক্টর বনভূমির মধ্যে প্রায় ৫ দশমিক ৩ লাখ হেক্টর জমি উজাড় হয়ে গেছে। বন উজাড়ের হার বছরে প্রায় ১০ হাজার হেক্টর।

‘আমরা ২০৩০ সালের মধ্যে ২ লাখ হেক্টর পুনরুদ্ধার করার পরিকল্পনা করছি এবং এটি অর্জনের জন্য উন্নয়ন সহযোগীদের সঙ্গে কাজ করব এবং সরকারি তহবিল বরাদ্দ করব।’

– দ্যা ডেইলি স্টার