ভারতীয় কূটনীতিকের সাথে আইন মন্ত্রণালয়ের দুই কর্মকর্তার গোপন বৈঠকের অভিযোগ, মন্ত্রণালয়ের প্রতিবাদ

নিজস্ব প্রতিবেদক: নাগরিকত্ব (সংশোধন) আইন (সিএএ) এবং জাতীয় নাগরিকপঞ্জি (এনআরসি) নিয়ে বিতর্কের জেরে যখন বাংলাদেশের কয়েকজন মন্ত্রী দিল্লি সফর বাতিল করেছেন, তখন ভারতীয় কূটনীতিকের সঙ্গে গোপন বেঠক করলেন আইন মন্ত্রণালয়ের দুই কর্মকর্তা। সম্প্রতি দেশের এক জাতীয় দৈনিক সুত্রে এ তথ্য জানা গেছে।

সুত্রে জানা গেছে, গত রোববার রাতে প্যান-প্যাসিফিক হোটেল সোনারগাঁওয়ে এ বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। আইন মন্ত্রণালয়ের লেজিসলেটিভ ও ড্রাফটিং বিভাগের সচিব নরেন দাস এবং একই বিভাগের যুগ্ম-সচিব কাজী আরিফুজ্জামান বৈঠকে অংশ নেয়। ভারতের পক্ষে বৈঠকে উপস্থিত ছিলো ডেপুটি হাই-কমিশনার বিশ্বদীপ দে। নৈশভোজের আড়ালে তারা এই বৈঠকে মিলিত হয়। বৈঠকে দেশের অভ্যন্তরীণ স্পর্শকাতর ও গুরুত্বপূর্ণ নানা বিষয় প্রসঙ্গ পায়। তবে এ বৈঠক সম্পর্কে আইন মন্ত্রণালয় তথা সরকার অবহিত নন বলে জানা গেছে।

বৈঠকের বিষয়ে আইন, বিচার ও সংসদ বিষয়ক মন্ত্রী আনিসুল হক বিস্ময় প্রকাশ করেন। পাল্টা প্রশ্ন করেন- কিসের মিটিং? এমন কোনো মিটিংয়ের কথা আমার জানা নেই। বিষয়টি আমি দেখছি।

নির্ভরযোগ্য সূত্র জানায়, বিতর্কিত নাগরিকত্ব আইন ও এনআরসি নিয়ে ভারতে উত্তেজনকার পরিস্থিতি বিরাজ করছে। এর মধ্যে ভারতের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ বাংলাদেশ সরকারের বিরুদ্ধে সংখ্যালঘুদের প্রতি অবহেলার অভিযোগ আনে। এ পরিপ্রেক্ষিতে বাংলাদেশের পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী শাহরিয়ার আলম গত রোববার ভারত সফর বাতিল করে। ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় আয়োজিত আন্তর্জাতিক সম্মেলন রাইসিনা সংলাপে তিনি আমন্ত্রিত অতিথি ছিলেন। ভারতের নাগরিকত্ব (সংশোধন) আইন (সিএএ) এবং জাতীয় নাগরিকপঞ্জি (এনআরসি) নিয়ে বিতর্ক তৈরির পর বাংলাদেশের তিনমন্ত্রী এক এক করে তিন মন্ত্রী দিল্লি সফর বাতিল করলেন। এসব সফর বাতিল নিয়ে মুখ খোলেনি সরকার। গত ১২ ডিসেম্বর স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামালের ভারত সফর বাতিল হয়। এর এক সপ্তাহ পর দুই দেশের নদী কমিশনের বৈঠকও বাতিল হয়।

বিশ্লেষকদের মতে, বিতর্কিত নাগরিকত্ব আইন এবং এনআরসি নিয়ে দুই দেশের মধ্যেও একটা উত্তেজনাকর পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে। কারণ সম্প্রতি ভারতের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ বাংলাদেশ সরকারের বিরুদ্ধে সংখ্যালঘুদের প্রতি অবহেলার অভিযোগ আনে। ঢাকাও কোনো রাখঢাক না করেই নিজেদের ক্ষোভের বিষয়টি ভারতকে জানিয়ে আসছে। পর পর কয়েকজন মন্ত্রী এবং প্রতিনিধি পর্যায়ের ভারত সফরের কর্মসূচি বাতিলই এর প্রমাণ। ভারত সম্পর্কে বাংলাদেশ সরকারের এই অবস্থানের বর্তমান পর্যায়ে ভারতীয় কূটনীতিকদের সঙ্গে আইন মন্ত্রণালয়ের একটি শাখার শীর্ষ কর্মকর্তাদের ব্যক্তিগত গোপন বৈঠক অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ এবং রহস্যজনক মনে করছেন বিশ্লেষকরা।

সূত্রটি জানায়, পূর্ব নির্ধারিত সময় অনুযায়ী সন্ধ্যা ৭টা ১৮ মিনিটে হোটেল সোনারগাঁওয়ের লবিতে আসে নরেন দাস। ৮ মিনিট ফোনে কথা বলে। এর মাঝে দুই পুলিশ সদস্য (একজনের নাম তোফাজ্জল) একটি কালো রঙের ব্রিফকেস নরেন দাসের হাতে তুলে দেয়। এর কিছুক্ষন পরই কাজী আরিফুজ্জামান হাজির হয়। ৭টা ৩৫ মিনিটে উপস্থিত হয় কাজী আরিফুজ্জামান। সঙ্গে ফুলের তোড়া। ৭টা ৪০ এর দিকে তারা ডিনারের টেবিলে বসে। আলাপচারিতার একপর্যায়ে নরেন দাস ব্রিফকেসটি ডেপুটি হাই-কমিশনার বিশ্বদীপ দে’র কাছে হস্তান্তর করে। এ ব্রিফকেসেই সরকারের অনেকগুরুত্বপূর্ণ নথি রয়েছে বলে জানা গেছে।

সূত্র জানায়, বৈঠকে অংশ নেয়া আইনমন্ত্রণালয়ের এই সংখ্যালঘু কর্মকর্তার মাধ্যমে ভারত বিশেষ কোনো বার্তা দিয়েছে। সেই সঙ্গে বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ নীতি-নির্ধারণী অনেক স্পর্শকাতর তথ্যও ওই দুই কর্মকর্তা ভারতীয় কূটনীতিকের হাতে তুলে দিয়েছে। যা স্বাধীন, সার্বভৌম বাংলাদেশের জাতীয় স্বার্থের পরিপন্থী। তাই মন্ত্রণালয় তথা সরকারকে না জানিয়ে ব্যক্তিগত পর্যায়ের গোপন বৈঠককে কর্মকর্তাদের শৃঙ্খলা ভঙ্গ, গুরুতর অপরাধ, গুপ্তচর বৃত্তি, রাষ্ট্র ও সরকারের বিরুদ্ধে গভীর ষড়যন্ত্র এবং রাষ্ট্রদ্রোহিতার শামিল বলে মনে করছেন মন্ত্রণালয়েরই একাধিক সিনিয়র কর্মকর্তা।

তাদের মতে, এ বৈঠক যদি সরকারের পক্ষ থেকে হতো তাহলে সেটির একটি আনুষ্ঠানিক রূপ থাকতো। বৈঠকের ভেন্যু হতো আইনমন্ত্রণালয় কিংবা বাংলাদেশ সরকারের অন্যকোনো দফতর। বৈঠকটি ভারতে অনুষ্ঠিত হলেও সেখানে দুই দেশের প্রধানমন্ত্রী, মন্ত্রী এবং সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় ও দফতরের কর্মকর্তাগণ উপস্থিত থাকতেন। কিন্তু গতকালের সন্ধ্যার বৈঠকটি ছিলো একেবারেই অনানুষ্ঠানিক। বন্ধু প্রতীম দুই দেশের মধ্যে লিগ্যাল এবং ড্রাফটিং বিভাগের কর্মকর্তাদের দক্ষতা বৃদ্ধি, ক্যাপাসিটি বিল্ডিং, ভারত-বাংলাদেশের সংসদ সংস্কৃতির বিষয়ে অভিজ্ঞতা বিনিময়ের মতো কোনো এজেন্ডা হলে সেটি আরো বৃহৎ পরিসরে দুই সরকারের উচ্চপর্যায়ে সম্পাদিত হতে পারে। সে ধরণের কিছু হলে মন্ত্রণালয়ের একটি বিভাগের মধ্যম পর্যায়ের কর্মকর্তা বিশেষকে দিয়ে সরকার রাষ্ট্রীয় গুরুত্বপূর্ণ কোনো বিষয়ের কূটনৈতিক আলোচনা চালাতো না। প্রটোকল এমনটি সমর্থন করে না। ড্রাফটিং ও লেজিসলেটিভ বিভাগের সচিব নরেন দাস এবং যুগ্ম-সচিব কাজী আরিফুজ্জামানকে সরকারের কোন দফতরের কোন কর্মকর্তা বৈঠক করার দায়িত্ব দিয়েছেন সেটি তাদের চিঠিতে উল্লেখ নেই। শুধু বলা হয়, এটি ‘সংসদীয় বৈঠক’ হিসেবে পরিগণিত হতে পারে। পরবর্তীতে উচ্চপর্যায়ে আরো বৈঠক হতে পারে বলেও ইঙ্গিত দেয়া হয় চিঠিতে।

সুত্রে জানা গেছে, নরেন দাসের বিরুদ্ধে বিদেশি গোয়েন্দা সংস্থার সঙ্গে সম্পর্ক থাকার অভিযোগ পুরনো। নাইকো দুর্নীতি মামলায় (নং-২০) বিএনপি’র চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়ার সঙ্গে আরো ৫ জনকে আসামি করা হয়। নরেন দাস ছিলো তাদের একজন। ২০০৭ সালের ৯ ডিসেম্বর দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) তৎকালীন সহকারী পরিচালক মুহাম্মদ মাহবুবুল আলম বাদী হয়ে রাজধানীর তেজগাঁও থানায় এ মামলা করেন। এজাহারে নরেন দাসের বিরুদ্ধে ১৯৪৭ সালের দুর্নীতি প্রতিরোধ আইনের ৫(২) ধারা এবং দন্ডবিধির ১০৯ ধারায় অভিযোগ আনা হয়। বলা হয়, কানাডিয়ান নাইকো কোম্পানির ভাইস প্রেসিডেন্ট কাশেদ শরীফ আইন মন্ত্রণালয়ের নরেন দাসকে একটি ল্যাপটপ কিনে দিতে বলে। তাকে একটি নম্বর দিয়ে নরেন দাসের সঙ্গে যোগাযোগ করতে বলে। ওই নম্বরে মাসুদুর রহমান যোগাযোগ করলে, নরেন দাস তাকে সচিবালয়ের গেটের সামনে এসে ল্যাপটপসহ ফোন করতে বলে। ওখানে তাকে ১৫/২০ মিনিট অপেক্ষা করিয়ে বের হয় এবং তার কাছে ল্যাপটপ হস্তান্তর করেন। ল্যাপটপটি এখনো জব্দ রয়েছে। তবে আলোচিত এ মামলার তদন্তকালে গ্রেফতার হয়ে ৩ মাস কারাভোগ করে নরেন দাস। একটি গোয়েন্দা সংস্থার হস্তক্ষেপে সে কারামুক্ত হয়। একই প্রক্রিয়ায় অব্যাহতি পায় মামলা থেকেও।

একই দফতরের অতিরিক্ত সচিব থাকাকালে নরেন দাসের বিরুদ্ধে বিভিন্ন দুর্নীতির অভিযোগ রয়েছে। তা সত্ত্বেও সেই গোয়েন্দা সংস্থার পছন্দে তাকে ড্রাফটিং উইংয়ের সচিব করা হয় বলে গুঞ্জন রয়েছে। গত ৩১ অক্টোবর সিনিয়র সচিব মোহাম্মদ শহিদুল হকের চুক্তিভিত্তিক নিয়োগের মেয়াদ শেষ হয়। গত ৩ নভেম্বর তার স্থলাভিষিক্ত হয় নরেন দাস।