ব্যাংক থেকে রেকর্ড পরিমাণ ঋণ নেবে সরকার

ব্যাংক থেকে রেকর্ড পরিমাণ ঋণ নেবে সরকার

নিজস্ব প্রতিবেদক: লকডাউনের কারণে বিপর্যস্ত অর্থনীতি। এ অবস্থায় রাষ্ট্রীয় জরুরি ব্যয় নির্বাহের জন্য চলতি মাসেই বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে ১২ হাজার কোটি টাকাসহ ব্যাংক খাত থেকে সরকারের নেওয়া ঋণের পরিমাণ দাঁড়াতে পারে ৮৮ হাজার কোটি টাকা। অর্থ মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, চলতি অর্থবছরে ব্যাংক থেকে সরকারের নেওয়া ঋণের পরিমাণ আগের রেকর্ড ভাঙতে যাচ্ছে।
অর্থ মন্ত্রণালয়ের অর্থ বিভাগের হিসাবে দেখা যায়, গত ১০ বছরের মধ্যে ব্যাংক ব্যবস্থা থেকে সরকারের সবচেয়ে বেশি ঋণ করার রেকর্ড ছিল ২০১৮-২০১৯ অর্থবছরে। ওই বছর ঋণের পরিমাণ ছিল ৩০ হাজার ৮৯৫ কোটি টাকা। কিন্তু লকডাউনের কারণে এ বছর ছয় মাসেই সে রেকর্ড ভেঙে গেছে।

অর্থ বিভাগের পরিসংখ্যানে দেখা যায়, ২০০৯-২০১০ অর্থবছরের সরকারকে ব্যাংক থেকে ঋণ নিতে হয়নি। উল্টো সে বছর বকেয়া ঋণ পরিশোধের পরিমাণ ছিল ২ হাজার ৯৩ কোটি টাকা। এর পরের অর্থবছর ২০১০-২০১১ অর্থবছরে ব্যাংক থেকে ঋণ নেওয়া হয় ২৫ হাজার ২১০ কোটি টাকা। ২০১১-২০১২ অর্থবছরে এর পরিমাণ দাঁড়ায় ২৭ হাজার ১৯১ কোটি টাকা। ২০১২-২০১৩ অর্থবছরে ২৭ হাজার ৪৬ কোটি টাকা, ২০১৩-২০১৪ অর্থবছরে ১৮ হাজার ১৬৮ কোটি টাকা, ২০১৪-২০১৫ অর্থবছরে ৫১৪ কোটি টাকা, ২০১৫-২০১৬ অর্থবছরে ১০ হাজার ৬১৪ কোটি টাকা ঋণ নেওয়া হয়। ২০১৬-২০১৭ অর্থবছরে ব্যাংক থেকে ঋণ নেওয়া হয়নি। উল্টো পরিশোধ করা হয়েছে ৮ হাজার ৩৭৯ কোটি টাকা। ২০১৭-২০১৮ অর্থবছরে ঋণ নেওয়া হয় ২৮ হাজার ২০৮ কোটি টাকা। গত ২০১৮-২০১৯ অর্থবছরে ঋণ নেওয়ার পরিমাণ বেড়ে দাঁড়ায় ৩০ হাজার ৮৯৫ কোটি টাকায়।

সূত্র জানায়, বাজেট ঘাটতি পূরণে প্রথমে ব্যাংক খাত থেকে ৪৭ হাজার ৩৬৪ কোটি টাকা ঋণ নেওয়ার লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছিল। কিন্তু লকডাউন পরিস্থিতির কারণে ব্যবসা-বাডুজ্য বন্ধ থাকায় লক্ষ্যমাত্রা অনুযায়ী রাজস্ব আদায় হচ্ছে না। এর ফলে সরকারের ব্যয় ঠিক রাখতে ব্যাংক থেকে ঋণ নেওয়ার লক্ষ্যমাত্রা বাড়িয়ে দেওয়া হয়।

সংশোধিত বাজেটে ব্যাংকিং খাত থেকে ঋণ নেওয়ার এই লক্ষ্যমাত্রা সংশোধন করে ৭২ হাজার ৯৫৩ কোটি টাকা পুনঃনির্ধারণ করা হয়। কিন্তু ৩১ মে পর্যন্ত শুধু ট্রেজারি বিল ও বন্ডের মাধ্যমেই সরকার নিট ঋণ নিয়েছে ৭৪ হাজার কোটি টাকা। অর্থ মন্ত্রণালয় থেকে চলতি জুনে আরো ১৪ হাজার ১৮০ কোটি টাকার ঋণ নেওয়ার কর্মসূচি বাংলাদেশ ব্যাংকে দেওয়া হয়েছে। ফলে এ ঋণ নেওয়ার কর্মসূচি আর পরিবর্তন না করলে অর্থবছর শেষে শুধু ব্যাংক ব্যবস্থা থেকেই সরকারের নিট ঋণের পরিমাণ দাঁড়াবে ৮৮ হাজার ১৮০ কোটি টাকা।

সরকারের এ ঋণ নেওয়ার কর্মসূচি আরো বাড়তে পারে। ৮৮ হাজার কোটি টাকার বাইরে বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে আরো ঋণ নেওয়ার সুযোগ আছে। উপায় উপকরণের মাধ্যমে ৬ হাজার কোটি টাকা এবং ওডির (ওভার ড্রাফট) মাধ্যমে আরো ৬ হাজার কোটি টাকা ধার নিতে পারবে সরকার। অর্থাৎ আপৎকালীন ব্যয় মেটানোর জন্য ১২ হাজার কোটি টাকা বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে স্বল্প সময়ের জন্য ধার নিতে পারে।

বর্তমানে সরকারকে ব্যাংকিং খাত থেকে যে হারে ঋণ নিতে হচ্ছে তাতে কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে বেশি হারে ঋণ নিতে হতে পারে। ৩১ মে পর্যন্ত বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে নিট ঋণ নেওয়া হয়েছে ৬০০ কোটি টাকা। এতে পরিবর্তন করা হতে পারে ঋণ নেওয়ার কর্মসূচি। আর তা হলে একটি অর্থবছরে ১ লাখ কোটি টাকার বেশি ঋণ নিতে হবে সরকারকে, যা হবে এ যাবৎকালে সর্বোচ্চ ঋণ।
চলতি ২০১৯-২০২০ অর্থবছরের বাজেটে সরকারের ব্যাংক থেকে ঋণ নেওয়ার প্রক্ষেপণ করা হয়েছিল ৪৭ হাজার ৩৬৪ কোটি। রাজস্ব আয় আশানুরূপ না হওয়ায় সরকার অর্থবছরের প্রথম ছয় মাসের মধ্যে ব্যাংক থেকে বেশি ঋণ নিয়ে ফেলে। ছয় মাসে ব্যাংক থেকে ঋণ নেওয়া হয় ৪৯ হাজার ১৫ কোটি টাকা। এই পরিস্থিতিতে মার্চ মাসে ঋণ নেওয়ার পরিমাণ সংশোধন করে নির্ধারণ করা হয় ৭২ হাজার ৯৫৩ কোটি টাকা। কিন্তু এখন সংশোধিত লক্ষ্যমাত্রা অতিক্রম করে গেছে সরকারের ব্যাংক ঋণ।

ব্যাংকিং খাত থেকে ঋণ নেওয়া প্রসঙ্গে অর্থ বিভাগের এক অতিরিক্ত সচিব বলেন, ‘সরকারের ব্যয়ের হিসাবটাই বাজেট। এই ব্যয় মেটানোর জন্য সরকার আয় করতে হয়। এই আয় করতে হয় রাজস্ব খাত থেকে। কিছু আসে বৈদেশিক সহায়তা খাত থেকে। কিন্তু এবার পরিস্থিতি সম্পূর্ণ ভিন্ন। রাজস্ব আয়ের অবস্থা খুবই খারাপ। কিন্তু সরকারকে ব্যয় করতেই হচ্ছে এবং তা ক্রমেই বাড়ছে। এ অবস্থায় সরকারকে বাধ্য হয়ে ব্যাংক থেকে ঋণ নিতে হচ্ছে। কারণ, অন্যান্য বছর সঞ্চয়পত্র বিক্রি করে সরকার ঋণ নিতো। কিন্তু বিধিনিষেধ আরোপের কারণে চলতি অর্থবছরে সঞ্চয়পত্র বিক্রি অনেক কমে গেছে। তাই বাধ্য হয়ে ব্যাংক থেকেই ঋণ নিতে হচ্ছে।