বেনাপোল সীমান্ত দিয়ে আসছে ইয়াবা-ফেনসিডিল

বেনাপোল সীমান্ত দিয়েই আসছে ইয়াবা-ফেনসিডিল

নিউজ ডেস্ক: পাঁচ-ছয় বছর ধরে ভারত থেকে দেশে গরু আসা পুরোপুরি বন্ধ রয়েছে। ভারতীয় গরুর চালানের একটি বড় অংশ দেশে ঢুকত যশোরের বেনাপোল সীমান্ত দিয়ে। প্রতিদিন হাজার হাজার গরু বিক্রির জন্য উঠত সংশ্লিষ্ট এলাকার হাটগুলোতে। এখন আর সেই অবস্থা নেই।

জানা গেছে, সীমান্ত দিয়ে গরু পাচার ঠেকাতে তৎপর ভারতীয় সীমান্তরক্ষীসহ (বিএসএফ) সেদেশের আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। সেই সুযোগে দেদারসে মাদকদ্রব্য কেনাবেচা করছে দুই পাড়ের মাদক কারবারিরা। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, আগে যারা গরুর ব্যাপারী ছিলেন, তারাই এখন মাদকের কারবারে নেমেছেন।

ভারত থেকে দেশে আসা মাদকের তালিকায় প্রথমেই রয়েছে ফেনসিডিল।

বেনাপোলের পুটখালী, দৌলতপুর গোগা ও তেরোঘর সীমান্ত দিয়ে এসব ভারতীয় মাদক দেশে আসে। যারা ভারত থেকে ফেনসিডিল-ইয়াবা নিয়ে আসে, তাদের তালিকাও রয়েছে বর্ডার গার্ড বাংলাদেশের (বিজিবি) কাছে। প্রায় দিনই লাখ লাখ টাকার অবৈধ মাদক নিয়ে তারা ধরাও পড়ছে বিজিবির হাতে। গত দুই বছর দুই মাসে এক কোটি ৭৪ লাখ ৩১ হাজার টাকার মাদক ও অবৈধভাবে আসা ভারতীয় পণ্য জব্দ করেছে বিজিবি।

পুটখালী বিজিবি কোম্পানি সদর সূত্রে জানা যায়, ২০১৯ সালে জব্দ করা মালামালের মধ্যে আট হাজার ৩৩১ বোতল ফেনসিডিল (আনুমানিক মূল্য ৩৩ লাখ ২৪ হাজার ৪০০ টাকা), ৯০ লাখ ৪৫ হাজার টাকার ভারতীয় পণ্যসহ আটক করা হয় ১৪ জনকে। একই বছর অবৈধ অনুপ্রবেশের দায়ে আটক করা হয় চার ভারতীয় নাগরিককে।

২০২০ সালে বিজিবি জব্দ করে পাঁচ হাজার ৭২৪ বোতল ফেনসিডিল (আনুমানিক মূল্য ২০ লাখ ১৩ হাজার ৭৪০ টাকা), ২০ লাখ ১৩ হাজার টাকার ভারতীয় পণ্য। আটক করা হয় একজনকে।

চলতি বছরের ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত জব্দ করা হয়েছে এক হাজার ৮৯৬ বোতল ফেনসিডিল (আনুমানিক মূল্য সাত লাখ ৫৮ হাজার ৪০০ টাকা)।

স্থানীয় ব্যবসায়ীরা জানান, সীমান্ত পাড়ি দিয়ে প্রতিদিন পুটখালীতে নিয়ে আসা হতো দু-তিন হাজার পর্যন্ত গরু। কিন্তু এখন একটি গরুও আসে না। পুটখালী বাজারে কয়েক একর জমির ওপর স্থাপিত গরুর খাটাল অব্যবহৃত অবস্থায় পড়ে আছে বহুদিন ধরে।

পুটখালীর একজন বড় গরু ব্যবসায়ী রায়হান শেখ। তিনি বলেন, ‘এই যে খাটাল দেখছেন, এখানে ভরা থাকত গরু। এই পথ দিয়ে অন্তত দুই হাজার গরু আসত দিনে, এখন একদম বন্ধ।’

সীমান্ত দিয়ে ফেনসিডিল-ইয়াবা কাদের হাত ধরে আসে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘আমাদের ব্যবসায়ীদের মধ্যেই আগে যারা সীমান্ত দিয়ে গরু নিয়ে আসতো তারা অনেকেই এখন অন্য ব্যবসা করছেন। কিন্তু কিছু অসৎ ব্যবসায়ী আছেন, যারা সীমান্তের সবকিছু জানে। মূলত এই অসৎ ব্যবসায়ীরাই ফেনসিডিল-ইয়াবার ব্যবসায় জড়িত।’

সীমান্ত এলাকা ঘুরে দেখা যায়, পুটখালী সীমান্তের পাশেই ইছামতী নদী। ভারতীয় সীমানার মধ্যে পড়া এই নদীতে নেই কোনো কাঁটাতার। দুই দেশের সীমারেখা চিহ্নিত করার জন্য রয়েছে শুধু ইট-সিমেন্টের পিলার। ইছামতী নদীর পাশেই রয়েছে ভারতের তেরোঘর এলাকা। এই তেরোঘরের অনেক বাসিন্দাই মাদককারবারে জড়িত।

ফেনসিডিলের দাম জিজ্ঞেস করলে তেরোঘরের এক বাসিন্দা বলেন, ‘যেটা জানি, প্রতি বোতল ফেনসিডিলের দাম এখন ৫০০ টাকার মতো।’

তেরোঘর ভারতের পশ্চিমবঙ্গ প্রদেশের ২৪ পরগনা জেলার বনগাঁ মহকুমার পেট্রাপোল মৌজায় অবস্থিত একটি ছিটমহল। এ ছিটমহলে জমির পরিমাণ মাত্র ৫ একর। বাংলাদেশের পকেটে হওয়ায় দৌলতপুর আর গাতীপাড়া গ্রামের লোকজন ছিটমহলের ওপর দিয়ে যাওয়া-আসা করে। বাংলাদেশের সীমানার কাছাকাছি তাদের বসবাস হওয়ায় ভারত থেকে মাদক পরিবহনে তাদের তেমন বেগ পেতে হয় না।

স্থানীয় সূত্রে জানা যায়, ইয়াবা-ফেনসিডিল তেরোঘরের কারবারিদের কাছ থেকে বাংলাদেশি অসাধু ব্যবসায়ীদের হাত ধরে পৌঁছে যায় দেশের বিভিন্ন এলাকায়। এছাড়া যারা আগে গরুর ব্যবসা করতেন সীমান্তের সবকিছুই তাদের চেনা-জানা। মূলত তাদেরই একটি অংশ বাংলাদেশে মাদক নিয়ে আসার কাজটি করছেন। এসব মাদক ব্যবসায়ী রাতারাতি টাকার মালিক বনে গেছেন। এর প্রভাব পড়ছে স্থানীয় তরুণ সমাজেও। অল্প বয়সীরা কৌতূহলেরবশে এসব মাদক গ্রহণ করছে। এরপর ধীরে ধীরে তা পরিণত হচ্ছে নেশায়।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক স্থানীয় একজন সাংবাদিক বলেন, দীর্ঘদিন ধরে যারা ভারত থেকে গরু এনে ব্যবসা করতেন তাদের একটি অংশ বর্তমানে মাদক ব্যবসায় জড়িয়ে পড়েছে। মাদকের কারণে একদিকে যেমন আমাদের আর্থিক ক্ষতি হচ্ছে অন্যদিকে শিশু-কিশোররাও নেশায় আসক্ত হয়ে পড়ছে। নৈতিক ও সামাজিক অবক্ষয়ের কারণে সমাজে বিশৃঙ্খলা বাড়ছে।

বিজিবি জানায়, আগের চেয়ে সীমান্ত দিয়ে মাদক আসার পরিমাণ কমেছে। নিয়মিত টহল, আধুনিক ক্যামেরা স্থাপন, থার্মাল ক্যামেরা স্থাপন ও সচেতনতার কারণে মাদকের চালানের পরিমাণ কমে গেছে। শূন্যের কোঠায় এখনো আসেনি। প্রায়দিনই বিজিবি মাদকের চালান জব্দ করছে।

গত এক মাসে ৫০টি মাদক মামলা হয়েছে জানিয়ে বেনাপোল পোর্ট থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মামুন খান বলেন, সীমান্ত দিয়ে মাদক আসা কমেছে, তবে মামলার সংখ্যা বেড়েছে। যখন যে সুযোগ পাচ্ছে সেই এ মাদক ব্যবসার সঙ্গে জড়িয়ে পড়ছে। পুলিশের অভিযান অব্যাহত রয়েছে, নিয়মিত অভিযানে মাদকসহ কারবারি আটক করছি এবং মামলা হচ্ছে।