বীজ উৎপাদন করেই অর্ধকোটি টাকার মালিক হায়দার

পাবনা সংবাদাদাতা: পাবনার চাটমোহর উপজেলার ছাইকোলা ইউনিয়নের চলনবিল অধ্যুষিত গ্রাম কাটেঙ্গা। বর্ষা মৌসুম এলেই ডুবে যায় এ গ্রামের বিস্তীর্ণ মাঠ। পানি নামলেই আবার জেগে ওঠে কৃষিজমি। পলিসমৃদ্ধ এসব জমিতে ব্যাপক ফলন হয়।

দুই দশকের বেশি সময় আগে কাটেঙ্গায় কৃষকদের প্রশিক্ষণ দেন কৃষি কর্মকর্তা আব্দুল খালেক।

কৃষিক্লাবে যখন প্রশিক্ষণ চলতো, তখন বাইরে দাঁড়িয়ে থাকতেন হায়দার আলী নামে এক কৃষিশ্রমিক। নিজের জমি-জমা না থাকা এবং অন্যের ক্ষেতে কাজ করায় ‘কৃষক’ পরিচয় দিতেও হীনমন্যতায় ভুগতেন তিনি। ফলে প্রশিক্ষণ নিতে ক্লাবে প্রবেশ করতেন না। বাইরে দাঁড়িয়ে শুনতেন কৃষি কর্মকর্তার কথা।

তবে তাতে মন ভরছিলো না হায়দার আলীর। একদিন কৃষি কর্মকর্তা আব্দুল খালেককে বলেন, আমাকে কী একটু প্রশিক্ষণ দেওয়া যায় না। আকুতি শুনে হায়দারকে কৃষিক্লাবে ভর্তি করে নেন আব্দুল খালেক। অন্য কৃষকদের সঙ্গে প্রশিক্ষণ নেন হায়দারও। ওই প্রশিক্ষণই হায়দারের জীবনের মোড় ঘুরিয়ে দেয়।

পলিসমৃদ্ধ জমিতে পেঁয়াজ বীজ উৎপাদন করে কৃষিশ্রমিক হায়দার আলী এখন স্বাবলম্বী। ১৩ বছর পেঁয়াজ বীজ উৎপাদন করে এখন প্রায় অর্ধকোটি টাকার মালিক তিনি।
হায়দার আলী লেখাপড়া করেননি। পোড় খাওয়া জীবনে অনেক কষ্ট ভুলে গেছেন। তবে যে কৃষি প্রশিক্ষণ তার জীবনের মোড় ঘুরিয়ে দিয়েছে, তা এখনো ভোলেননি। কৃষি কর্মকর্তা খালেকের নির্দেশনা এখনো তার কানে বাজে।

নিঃস্ব থেকে স্বাবলম্বী হয়ে ওঠা হায়দার আলী চাটমোহরের চলনবিল পাড়ের কাটেঙ্গা গ্রামের সরু প্রামাণিকের ছেলে। বীজ উৎপাদন করে স্বাবলম্বী হয়ে ওঠা এ কৃষক তার সাফল্যের গল্প জানাতে গিয়ে এসব কথা জানান।

হায়দার আলী জানান, পেঁয়াজ বীজ উৎপাদন দিয়ে শুরু করলেও পরবর্তীতে তিনি কৃষি কর্মকর্তা আব্দুল খালেকের কাছ থেকে ধান, সবজি, পাট, ফুলকপি, বাঁধাকপি ও রসুন চাষ ও এর বীজ উৎপাদনের প্রশিক্ষণ নেন। তবে বর্তমানে তিনি পেঁয়াজ বীজ উৎপাদনে বেশি নজর দিয়েছেন।

তিনি বলেন, ২০০৮ সালে চার কাঠা জমিতে পেঁয়াজ বীজ করেছিলেন। ১৬ কেজি ফলন পেয়েছিলেন। তারপরের বছর ১৬ কাঠা জমিতে ৯৩ কেজি পেঁয়াজ বীজ হয়েছিল। তার মধ্যে ৮৫ কেজি বিক্রি করেছিলেন। বাকি আট কেজি নিজে আবাদের জন্য রেখে দিয়েছিলেন। পেঁয়াজ বীজ (কদম চাষ) চাষ করার পর যে পেঁয়াজ পাওয়া যায়, তা বিক্রি করেই আবাদের খরচ উঠে যায়।

হায়দার জানান, চলতি বছর তার ঘরে এসেছে আট মণ ২০ কেজি পেঁয়াজ বীজ। মৌসুমের শুরুতে যদি তিনি এ পেঁয়াজ বীজ বিক্রি করতেন, তবুও অন্তত চার লাখ টাকা পেতেন। তবে বীজ ঘরে সংরক্ষণ করায় মৌসুমের শেষে এসে বীজের দাম বেড়েছে। কেজিপ্রতি চার হাজার টাকা দরে বিক্রির আশা করছেন তিনি। প্রত্যাশা অনুযায়ী দাম পেলে এবার প্রায় ১০ থেকে ১১ লাখ টাকার পেঁয়াজ বীজ বিক্রি করতে পারবেন হায়দার।

সফল এ কৃষক বলেন, মূলত আমি লাখপতি হয়ে উঠেছি ২০১২ সালেই। ওই সময় আমার চাষি হিসেবে সফল হয়ে ওঠার শুরু। প্রায় এক যুগ পর এখন আমার নিজের নামে আড়াই বিঘা জমি। বাড়ির সঙ্গে জমি কিনেছি। কিছু জমি লিজ নিয়েছি। ঘর পাকা করেছি, মাছ চাষের জন্য পুকুর খনন করেছি। বাড়িতে গরু পালন করছি। পুরো বাড়িটা এখন খামার। অথচ এক সময় আমি অন্যের বাড়িতে কাজ করতাম।

হায়দার আলী আরও বলেন, আধুনিক কৃষি প্রশিক্ষণে আমার ভাগ্যের চাকা ঘুরেছে। কৃষি কর্মকর্তা আব্দুল খালেকের পরামর্শে পেঁয়াজ বীজ উৎপাদন করেই সফলতা এসেছে। বছরে এখন সর্বসাকুল্যে আমি প্রায় ৬০ লাখ টাকা আয় করতে পারছি। নিজে পড়ালেখার সুযোগ না পেলেও সন্তানদের স্কুলে পাঠাচ্ছি। তাদেরকে উচ্চশিক্ষায় শিক্ষিত করতে চাই।
জানতে চাইলে কৃষি কর্মকর্তা আব্দুল খালেক বলেন, অন্যের বাড়িতে কাজ করে আইপিএম প্রশিক্ষণ নেওয়াটা হায়দার আলীর জন্য অনেক কঠিন ছিল। তবে তার আগ্রহের কারণে তাকে পরামর্শ দিয়ে আজকের অবস্থানে আনা সম্ভব হয়েছে।

তিনি বলেন, প্রশিক্ষণ নেওয়ার পর অনেকে আবাদ শুরু করলেও পরে আর যোগাযোগ রাখেন না। ফলে তা দীর্ঘমেয়াদি হয় না। কিন্তু হায়দার তার ক্ষেতের ফসলের ব্যাপারে যোগাযোগ রাখতেন। তার ক্ষেত পরিদর্শনে উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা রওশন আলমকেও নিয়ে গেছি আমি। এতে তিনি আরও উৎসাহিত হয়েছেন। হায়দারের সফলতায় আমি ভালো অনুভব করি। আমার দেওয়া প্রশিক্ষণ ও নিজের পরিশ্রমে তিনি আজকের অবস্থানে, এটা ভাবতেই ভালো লাগা কাজ করে।

পরিশ্রমী চাষি হায়দার আলী তার মেয়েকে কৃষি ডিপ্লোমা করাচ্ছেন। তিনি বলেন, আমি অন্যের বাড়িতে কাজ করতাম, কৃষি কর্মকর্তাদের পরামর্শে চাষাবাদ করে সফল হয়েছি। এখন দুই সন্তানকে শিক্ষিত করতে চাই।

চাটমোহর উপজেলার উপ-সহকারী কৃষি কর্মকর্তা সোহরাব হোসেন বলেন, আমি নিয়মিত হায়দার আলীর কৃষিকাজের খোঁজ খবর রাখি। গত মৌসুমেও হায়দারকে এক একর পেঁয়াজ বীজ করার প্রদর্শনী প্লটের ব্যবস্থা করে দেওয়া হয়েছিল। সেখানেও তিনি সফল হয়েছেন।

পাবনা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরে উপ-পরিচালক আব্দুল কাদের বলেন, বীজ উৎপাদনে প্রান্তিক চাষি হায়দার আলী স্বাবলম্বী হয়েছেন। শুধু তিনি নন, তার কাছ থেকে অন্য চাষিরা উন্নত বীজ কিনে লাভবান হচ্ছেন। এতে দেশের খাদ্য উৎপাদন বৃদ্ধিতে ভূমিকা রাখছে। হায়দার আলীর মত অগ্রসর চাষির সংখ্যা যত বাড়বে, দেশে তত খাদ্য উৎপাদন বাড়বে। দেশ কৃষি সমৃদ্ধির দিকে এগিয়ে যাবে।