রাজাকার মীর কাসেম ও বিলিয়নিয়ার মীর কাসেম

নিউজ নাইন২৪ডটকম, ডেস্কঃ মওদুদীবাদী জামাত নেতাদের মধ্যে সবচেয়ে বেশি বিত্ত-বৈভবের মালিক হচ্ছে মানবতাবিরোধী অপরাধে মৃত্যুদন্ডপ্রাপ্ত আসামী রাজাকার মীর কাসেম আলী। জামায়াতের সর্বোচ্চ নীতিনির্ধারণী ফোরাম কেন্দ্রীয় নির্বাহী পরিষদের সদস্য কাসেম একজন বিলিয়নিয়ার ব্যবসায়ী। মওদুদীর আদর্শে অনুপ্রাণিত দল জামাত-শিবিরের পৃষ্ঠপোষক বা অর্থের প্রধান জোগানদাতাও তাকেই বলা হয়।

নামে-বেনামে শত শত ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের মালিক এই জামাত নেতা। মূলত অর্থবিত্তের কারণেই জামায়াত-শিবিরের রাজনীতিতে রয়েছে তার ব্যাপক প্রভাব।

রাজাকার কাসেম আলীর বেড়ে ওঠা :

মীর কাসেম আলীর জন্ম ১৯৫২ সালে মানিকগঞ্জের হরিরামপুর উপজেলার চালা গ্রামে। তার বাবা তৈয়ব আলী বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডে চাকরি করতো। চার ভাইয়ের মধ্যে সে দ্বিতীয়। মীর কাসেমকে এলাকার মানুষ মিন্টু নামেই চেনেন। বাবার চাকরির সুবাদে পরিবারের সঙ্গে থাকতো চট্টগ্রামে। ভর্তি হয় চট্টগ্রাম কলেজে। ১৯৭০ সালে চট্টগ্রাম সরকারি কলেজের ছাত্র থাকাকালে জামাতের ছাত্রসংগঠন ইসলামী নামধারী ছাত্রসংঘের চট্টগ্রাম শাখার সভাপতি হয় সে।

একাত্তরে স্বাধীনতা বিরোধী ভূমিকা:

১৯৭১ সালে স্বাধীনতাযুদ্ধের সময় জামাত দেশের সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করে পক্ষ নেয় পাকিস্তানের। রাজাকার অর্ডিন্যান্স জারির পর জামাতে মওদুদী তাদের ছাত্রসংগঠন ছাত্রসংঘের নেতাদের নিজ নিজ জেলার আলবদর বাহিনীর প্রধান নিযুক্ত করে। সেই সুবাদে রাজাকার কাসেম চট্টগ্রাম জেলার প্রধান হয়। তার বিরুদ্ধে অভিযোগ, ১৯৭১ সালের ২ আগস্ট চট্টগ্রাম মুসলিম ইনস্টিটিউটে তার নেতৃত্বে স্বাধীনতাবিরোধী সমাবেশ আয়োজন করা হয়। সভাপতি হিসেবে সে তার ভাষণে বলেছে, গ্রামগঞ্জে প্রতিটি এলাকায় খুঁজে খুঁজে পাকিস্তানবিরোধীদের শেষ চিহ্নটি মুছে ফেলতে হবে।

মীর কাসেমের বিরুদ্ধে আরেকটি বড় অভিযোগ হচ্ছে- সে সংখ্যালঘু পরিবারের বাড়ি ‘মহামায়া ভবন’ দখল করে বানায় টর্চার সেল। ডালিম হোটেল নামে পরিচিত ওই টর্চার সেলে এনে মুক্তিযোদ্ধাদের ওপর নির্মম নির্যাতন করা হতো।

স্বাধীন দেশে রাজাকার মীর কাসেম:

জানা যায়, স্বাধীনতার পর মীর কাসেম ঢাকায় আসে। কিন্তু কিছু দিন যেতে না যেতেই মুক্তিযোদ্ধাদের রোষানলে পড়ার ভয়ে চলে যায় লন্ডনে। সেখান থেকে সউদী আরব। সউদীতে থাকাকালীন সেখানকার অনেক গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তির সঙ্গে তার সুসম্পর্ক হয়। বঙ্গবন্ধু হত্যার পর দেশে ফিরে আসে রাজাকার মীর কাসেম।

মীর কাসেমের নেতৃত্বেই ১৯৭৭ সালের ৬ ফেব্রুয়ারি ইসলামী ছাত্রসংঘ নাম পরিবর্তন করে ছাত্রশিবির নামে আত্মপ্রকাশ করে। সে হয় শিবিরের প্রথম কেন্দ্রীয় সভাপতি। এরপর মীর কাসেমকে আর পেছন ফিরে তাকাতে হয়নি। মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোর সঙ্গে সুসম্পর্ক থাকার কারণে ১৯৮০ সালে সে রাবেতা আল ইসলামীর এ দেশীয় পরিচালক হয়।

মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোর টাকায় আস্তে আস্তে গড়ে তোলে ইসলামী ব্যাংক, ইবনে সিনা ট্রাস্ট ও ইবনে সিনা ফার্মাসিউটিক্যালস। মওদুদীবাদী জামাত ও শিবিরের আয় ও কর্মসংস্থানের বড় উৎস হয়ে দাঁড়ায় এসব প্রতিষ্ঠান। সঙ্গে সঙ্গে জামাত-শিবিরের রাজনীতিতে বাড়তে থাকে তার আধিপত্য।

যত ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের মালিক রাজাকার মীর কাসেম:

রাজাকার মীর কাসেম আলী দলীয় আর্থিক ফান্ড সমৃদ্ধ করার পাশাপাশি নিজেও হয়েছে শত শত কোটি টাকার মালিক। ব্যাংক, চিকিৎসাসেবা, পরিবহণ, টেলিযোগাযোগ, গণমাধ্যম ও শিক্ষা সব খাতেই রয়েছে তার দাপুটে বিচরণ ।

রাজাকার মীর কাসেম আলী মধ্যপ্রাচ্যভিত্তিক আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠান রাবেতা আল ইসলামীর বাংলাদেশ পরিচালক, ইসলামী ব্যাংকের প্রতিষ্ঠাতা ভাইস চেয়ারম্যান ও পরিচালক, ইসলামী ব্যাংক ফাউন্ডেশনের প্রতিষ্ঠাতা সদস্য। ইবনে সিনা ট্রাস্ট (প্রশাসন) ও ইবনে সিনা ফার্মাসিউটিক্যালসের বোর্ড অব ডিরেক্টরের সদস্যও সে।

এই ট্রাস্টের আটটি হাসপাতাল, ডায়াগনস্টিক ও ইমেজিং সেন্টার, একটি মেডিক্যাল কলেজ, একটি নার্সিং কলেজ ও একটি ফার্মাসিউটিক্যালস কোম্পানি, ইসলামী ব্যাংক হাসপাতাল, ইসলামী ব্যাংক স্কুল ও কলেজ এবং দিগন্ত পেপার মিলের মালিক কাসেম আলীই। সে ফুয়াদ আল খতিব ফাউন্ডেশনের প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান, অ্যাগ্রো ইন্ডাস্ট্রিয়াল ট্রাস্ট (এআইটি) ও বাংলাদেশ সাংস্কৃতিক কেন্দ্রের প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান।

দিগন্ত মিডিয়া করপোরেশনের চেয়ারম্যান মীর কাসেম আলী। এর অধীনে রয়েছে দৈনিক নয়া দিগন্ত পত্রিকা আর দিগন্ত টেলিভিশন।

এ ছাড়া মীর কাসেম আলীর ব্যক্তিগত বাণিজিক গ্রুপের নাম ‘কেয়ারী’। সে কেয়ারী হাউজিং ও ইডেন শিপিং লাইনসের চেয়ারম্যান। নামের আগে ‘কেয়ারী’ রয়েছে এ রকম ১০টি কোম্পানির পরিচালক রাজাকার মীর কাসেম আলী। এগুলো হলো- কেয়ারী লিমিটেড, কেয়ারী পোলট্রি হ্যাচারি অ্যান্ড প্রসেস, কেয়ারী স্প্রিং, কেয়ারী শান, কেয়ারী ট্যুরস অ্যান্ড সার্ভিসেস, কেয়ারী তাজ, কেয়ারী কালার সেন্টার, কেয়ারী ঝর্ণা, কেয়ারী রিয়েল এস্টেট ও কেয়ারী টেলিকম লিমিটেড।

কক্সবাজারের টেকনাফ থেকে সেন্ট মার্টিনে যাওয়ার জন্য রয়েছে মীর কাসেমের একক মালিকানাধীন বিলাসবহুল পাঁচটি প্রমোদতরি কেয়ারী ক্রইজ, কেয়ারী ডাইন, কেয়ারী সিন্দবাদ, কেয়ারী কর্ণফুলী ও কেয়ারী তরঙ্গ।

এ ছাড়া কেয়ারী গ্রুপের সহস্রাধিক অ্যাপার্টমেন্ট ও বিপণি বিতান রয়েছে ঢাকা, চট্টগ্রাম, কক্সবাজারসহ বিভিন্ন স্থানে।

বিচার ঠেকাতে রাজাকার মীর কাসেমের তৎপরতা:

জানা যায়, মানবতাবিরোধী বিচারের কার্যক্রমকে বাধাগ্রস্ত করতে মীর কাসেম আলী ২০১০ সালের ১০ মে ছয় মাসের জন্য যুক্তরাষ্ট্রের কনসালট্যান্সি ফার্ম কেসিডি অ্যান্ড অ্যাসোসিয়েটসের সঙ্গে চুক্তি করে। যুক্তরাষ্ট্র ও বাংলাদেশ সরকারের ওপর চাপ প্রয়োগ ও লবিং করাই ওই চুক্তির লক্ষ্য।

চুক্তি অনুযায়ী কনসালট্যান্সি ফার্মটি মীর কাসেম আলীর পক্ষে আমেরিকান কংগ্রেস, সিনেট সদস্য এবং ইউএস প্রশাসনের প্রধান সিদ্ধান্ত গ্রহণকারীদের সঙ্গে সম্পর্ক উন্নয়ন করবে। একই সঙ্গে দক্ষিণ এশিয়ার বৈদেশিক নীতির বিষয়ে মতামত দেবে।

তারই লবিংয়ে হাউস অব কমন্সের শক্তিশালী একটি লবিস্ট গ্রুপ কাজ শুরু করে এবং তারা যুক্তরাজ্যসহ ইউরোপের বিভিন্ন শহরে সেমিনার ও আলোচনা অনুষ্ঠানের আয়োজন করতে থাকে।

মীর কাসেম আলীর ভাই মীর মাসুম আলী ও জামাত আমির মতিউর রহমান নিজামীর ছেলে নাকীবুর রহমান নিজামীর তত্ত্বাবধানে ‘অর্গানাইজেশন ফর পিস অ্যান্ড জাস্টিস’ এবং ‘হিউম্যান রাইটস ডেভেলপমেন্ট ইন বাংলাদেশ’ চালাতে শুরু করে নানা প্রচারণা। ‘ক্লোয়াক্রম অ্যাডভাইজর’ ও ‘কে গ্লোবাল’ নামে দুটি লবিং প্রতিষ্ঠানও সাবকনট্রাক্টের ভিত্তিতে কাজ শুরু করে তাদের সঙ্গে।

অবশেষে বিচারের মুখোমুখি: এত কিছু করেও শেষ রক্ষা পায়নি জামাতের পৃষ্ঠপোষক প্রভাবশালী এই ব্যবসায়ী রাজাকার। জামাতের নির্বাহী পরিষদের সদস্য রাজাকার মীর কাসেমের বিরুদ্ধে ২০১২ সালের ১৭ জুন গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি করে ট্রাইব্যুনাল।

ওই দিন বিকেলেই মতিঝিলে দৈনিক নয়া দিগন্ত কার্যালয়ের (দিগন্ত মিডিয়া করপোরেশন) থেকে তাকে গ্রেফতার করে বিকেল সোয়া ৪টার দিকে ট্রাইব্যুনালে হাজির করা হয়।

এরপর ২০১৩ সালের ১৬ মে মীর কাসেমের বিরুদ্ধে ১৪টি অভিযোগ দাখিল করে রাষ্ট্রপক্ষ। ২৬ মে তার বিরুদ্ধে অভিযোগ আমলে নেয় ট্রাইব্যুনাল-১। এরপর মামলাটি ট্রাইব্যুনাল-২এ স্থানান্তর করা হয়। গত বছরের ৫ সেপ্টেম্বর মীর কাসেম আলীকে ১৪টি ঘটনায় অভিযুক্ত করে অভিযোগ গঠন করে ট্রাইব্যুনাল।

বিচারিক কার্যক্রম শেষে ২০১৪ সালের ২ নভেম্বর চেয়ারম্যান বিচারক ওবায়দুল হাসানের নেতৃত্বাধীন আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-২ মীর কাসেমকে মৃত্যুদণ্ডের রায় প্রদান করেন। রাষ্ট্রপক্ষের আনীত ১১ ও ১২ নম্বর অভিযোগে মুক্তিযোদ্ধা জসিম ও জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরীকে হত্যার দায়ে আদালত তাকে মৃত্যুদণ্ডের আদেশ দেয়। এর মধ্যে ১২ নম্বর অভিযোগে সংখ্যাগরিষ্ঠের ভিত্তিতে রায় প্রদান করা হয়।

২০১৪ সালের ৩০ নভেম্বর ট্রাইব্যুনালের দেয়া মৃত্যুদন্ড থেকে বেকসুর খালাস চেয়ে আপিল করেন মীর কাসেমের আইনজীবীরা। আপিলে তার খালাসের পক্ষে ১৮১টি যুক্তি তুলে ধরা হয়।

চলতি বছরের ১৭ ফেব্রুয়ারি থেকে শুরু হয়ে ২৪ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত মোট ১১ কার্য দিবস মীর কাসেমের পক্ষে-বিপক্ষে আপিল শুনানি অনুষ্ঠিত হয়। আপিল শুনানি শেষে চূড়ান্ত রায়ের জন্য আজকের দিন ধার্য করেছিলেন আদালত। চূড়ান্ত রায়ে মৃত্যুদন্ড বহাল থাকায় অবশেষে ফাঁসির দড়িতেই ঝুলতে যাচ্ছেন প্রভাবশালী এ জামাত নেতা।