বিদেশিদের চাপে টালমাটাল শেয়ারবাজার

ব্রোকারেজ হাউজগুলো হিমশিম খাচ্ছে

নিউজ ডেস্ক : দেশের শেয়ারবাজার থেকে বিদেশি বিনিয়োগকারীরা যে পরিমাণ টাকার শেয়ার কিনছেন বিক্রি করে দিচ্ছেন তার থেকে বেশি। সদ্য বিদায় নেয়া অর্থবছর (২০১৮-১৯) জুড়েই বিদেশিদের এমন প্রবণতা দেখা গেছে। অর্থবছরের ১২ মাসের মধ্যে ৯ মাসেই বিদেশিরা যে পরিমাণ টাকার শেয়ার কিনেছেন বিক্রি করেছেন তার চেয়ে বেশি। বাজারে আস্থা না পাওয়ায় বিদেশিরা এভাবে শেয়ার বিক্রি করছেন বলে অভিমত শেয়ারবাজার সংশ্লিষ্টদের।

বিদেশি বিনিয়োগকারীদের শেয়ার ক্রয়-বিক্রয়ের তথ্যের ওপর ভিত্তি করে ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের (ডিএসই) হালনাগাদ তথ্য পর্যালোচনা করে দেখা যায়, ২০১৮-১৯ অর্থবছরজুড়ে বিদেশি বিনিয়োগকারীরা শেয়ারবাজার থেকে যে টাকার শেয়ার কিনেছেন, তার চেয়ে ১৮৩ কোটি ৭০ লাখ ৮৫ হাজার টাকার বেশি বিক্রি করেছেন।

এর আগে দেশের শেয়ারবাজারের ইতিহাসে এক অর্থবছরে বিদেশি বিনিয়োগকারীদের শেয়ার বিক্রির এমন প্রবণতা দেখা যায়নি। বিদেশি বিনিয়োগকারীদের মাসের পর মাস শেয়ার বিক্রির চাপ অব্যাহত থাকায় সার্বিক শেয়ারবাজারেও মন্দাভাব দেখা দিয়েছে। প্রায় পাঁচ মাস ধরে মন্দা চলছে শেয়ারবাজারে।

বিশ্লেষকরা বলছেন, শেয়ারবাজারে বিদেশিদের বিনিয়োগের পরিমাণ খুব বেশি না। কিন্তু সমস্যা হলো- বিদেশিরা যখন শেয়ার বিক্রি করে একযোগে করে। ফলে বাজারে এক ধরনের আতঙ্ক তৈরি হয়। যে কারণে বিদেশিদের অব্যাহত শেয়ার বিক্রির চাপের কারণে সার্বিক শেয়ারবাজারে মন্দাভাব দেখা দিয়েছে।

তাদের মতে, সাধারণ ও প্রাতিষ্ঠানিক সব ধরনের বিনিয়োগকারীর মধ্যেই এক ধরনের ধারণা আছে- বিদেশি বিনিয়োগকারীরা খুবই দক্ষ। ফলে তাদের শেয়ার বিক্রির চাপ বাড়ার পেছনে নেতিবাচক কিছু থাকতে পারে, এমন ধারণার কারণে বাজারে খুব সহজে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে।

ডিএসইর পরিচালক মিনহাজ মান্নান ইমন বিদেশিদের শেয়ার বিক্রির বিষয়ে সাংবাদিকদের বলেন, বিদেশিদের কিছুটা অনাস্থা আসছে। অর্থনৈতিক পূর্বাভাস এবং ব্যাংক ব্যবস্থার ওপর তাদের অনাস্থা আছে।

তিনি বলেন, বিদেশিরা যখন শেয়ার বিক্রি করে তখন বুঝতে হবে কোনো তথ্য আছে। বিদেশিরা কোনো তথ্য ছাড়া শেয়ার বিক্রি করে না। বিদেশিরা নিশ্চয় আস্থা পাচ্ছেন না।

তথ্য পর্যালোচনায় দেখা যায়, ২০১৮-১৯ অর্থবছরের শেষ মাস জুনে বিদেশিরা যে পরিমাণ টাকার শেয়ার কিনেছেন বিক্রি করেছেন তার চেয়ে ১০ কোটি ৫২ লাখ টাকা বেশি। মাসটিতে বিদেশিরা ২৯৪ কোটি ৯৪ লাখ টাকার শেয়ার ক্রয়ের বিপরীতে বিক্রি করেছেন ৩০৫ কোটি ৪৬ লাখ টাকার শেয়ার।

জুনের মতো আগের তিন মাসেও বিদেশিদের শেয়ার বিক্রির চাপ ছিল। এর মধ্যে মে মাসে বিদেশিরা ক্রয়ের চেয়ে ৬৫ কোটি ১৭ লাখ টাকার বেশি শেয়ার বিক্রি বেশি করেছেন। তার আগের মাস এপ্রিলে ১৫৪ কোটি ১৯ লাখ টাকা। আর মার্চে ক্রয় থেকে বিক্রি বেশি ছিল ১২৩ কোটি ৭১ লাখ টাকা।

শেষ চার মাসের মতো ২০১৮-১৯ অর্থবছরের শুরুতেও বিদেশিদের শেয়ার বিক্রির চাপ ছিল। অর্থবছরের প্রথম মাস জুলাইয়ে বিদেশিরা যে পরিমাণ টাকার শেয়ার কেনেন তার চেয়ে ৩২ কোটি ৭১ লাখ টাকার বেশি বিক্রি করেন। পরের মাস আগস্টেও এই ধারা অব্যাহত থাকে। মাসটিতে ৫ কোটি ৭৫ লাখ টাকা ক্রয় থেকে বিক্রি বেশি ছিল বিদেশিদের।

অর্থবছরের প্রথম দুই মাস শেয়ার বিক্রির চাপ অব্যাহত রাখার পর সেপ্টেম্বরে এসে বিদেশিরা শেয়ার ক্রয়ের পরিমাণ বাড়ান। মাসটিতে বিদেশি বিনিয়োগকারীরা বিক্রির থেকে ৩৫ কোটি ১৬ লাখ টাকার শেয়ার বেশি ক্রয় করেন।

তবে একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের ডামাডোলের ভেতরে অক্টোবরে আবার পাল্টে যায় সেই দৃশ্য। মাসটিতে বিদেশিদের শেয়ার ক্রয় থেকে বিক্রি বেশি হয় ২০১ কোটি ২৮ লাখ টাকা। বিদেশিদের শেয়ার বিক্রির এই চাপ ভোটের আগ পর্যন্ত অব্যাহত থাকে। ফলে নভেম্বর মাসে শেয়ার ক্রয় থেকে বিক্রি বেশি হয় ২২ কোটি ৫০ লাখ এবং ডিসেম্বরে ১০১ কোটি ৫৩ লাখ টাকা।

তবে সংসদ নির্বাচনের ভোটের পর নতুন বছরের প্রথম দুই মাস শেয়ার ক্রয়ে মনোযোগী হন বিদেশিরা। এর মধ্যে জানুয়ারি মাসে শেয়ার বিক্রি থেকে ক্রয় বেশি হয় ১৭৫ কোটি ২৯ লাখ টাকা। আর পরের মাস ফেব্রুয়ারিতে শেয়ার বিক্রির থেকে ক্রয় বেশি ছিল ৩২৩ কোটি ১৮ লাখ টাকা। তবে মার্চে এসে আবার দৃশ্যপট পাল্টে যায়। শেয়ার বিক্রির চাপ বাড়ায় বিদেশিরা, যা অর্থবছরের শেষ পর্যন্ত চলে।

বিদেশিদের অব্যাহত শেয়ার বিক্রির চাপের প্রভাবে গত চার মাসে ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের প্রধান মূল্য সূচক ডিএসইএক্স কমেছে ৩২৭ পয়েন্ট। ফেব্রুয়ারি মাস শেষে ডিএসইর প্রধান মূল্য সূচক ছিল ৫ হাজার ৭১১ পয়েন্টে, যা ২ জুলাই লেনদেন শেষে দাঁড়িয়েছে ৫ হাজার ৩৮৪ পয়েন্টে।

সূচকের বড় ধরনের পতনের কারণে মোটা অঙ্কের বাজার মূলধন হারিয়েছে ডিএসই। ফেব্রুয়ারি মাসের শেষ কার্যদিবসের লেনদেন শেষে ডিএসইর বাজার মূলধন ছিল ৪ লাখ ১৫ হাজার ৭৩ কোটি টাকা, যা ২ জুলাই লেনদেন শেষে দাঁড়ায় ৩ লাখ ৯৮ হাজার ৮০ কোটি টাকা। অর্থাৎ চার মাসে ডিএসই ১৬ হাজার ৯৩ কোটি টাকা মূলধন হারায়।

এ বিষয়ে ডিএসইর এক সদস্য বলেন, শেয়ারবাজারে বিদেশি বিনিয়োগ আসে হাতে গোনা কয়েকটি হাউজের মাধ্যমে। সম্প্রতি শেয়ারবাজারে যে দুরবস্থা দেখা দিয়েছে এর পিছনে বিদেশি বিনিয়োগকারীদের একটি বড় ভূমিকা রয়েছে। বিদেশি বিনিয়োগকারীদের অব্যাহত শেয়ার বিক্রির চাপের কারণে বাজারে আতঙ্ক ছড়িয়েছে।

শেয়ারবাজারে বিদেশিদের শেয়ার বিক্রির প্রভাব সম্পর্কে ডিএসইর পরিচালক মিনহাজ মান্নান ইমন বলেন, বিদেশিরা যখন শেয়ার বিক্রি করে তখন বাজারে এক ধরনের নেতিবাচক প্রভাব পড়ে। বিদেশিদের শেয়ার বিক্রির চাপ বাংলাদেশের বড় বিনিয়োগকারীদেরও নিরুৎসাহিত করে।