প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশনাও মানছে না ব্যাংকগুলো

নিজস্ব প্রতিবেদক : সুদের হার কমাতে ব্যবসায়ীদের দাবি এবং প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশনা সত্ত্বেও উল্টো পথে চলছে ব্যাংকগুলো। এটি সিঙ্গেল ডিজিটে (এক অঙ্কে) নামানোর কথা বলে সরকারের কাছ থেকে নানা সুবিধা নিলেও কাজের কাজ কিছুই হয়নি। এ বিষয়ে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ কঠোর হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করলেও উল্টো বেড়েছে সুদের হার!
ব্যবসায়ীদের অভিযোগ, উচ্চ সুদে ঋণ নিয়ে ব্যবসা করতে হচ্ছে। সুদের হার না কমালে বিশ্ববাজারে টিকে থাকা কঠিন হয়ে পড়বে। অন্যদিকে ব্যাংক-সংশ্লিষ্টরা বলছেন, খেলাপি ঋণের প্রভাব, তারল্য সংকট এবং আমানতের তুলনায় ঋণের চাহিদা বেশি থাকায় সুদের হার কমানো যাচ্ছে না।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, তারল্য সংকটে বেশি সুদের অফার করে আমানত সংগ্রহ করছে অনেক ব্যাংক। এখনও ১০ থেকে ১১ শতাংশ সুদে আমানত নেয়া হচ্ছে। ফলে পরিচালন খরচ মিটিয়ে ঋণ দিতে হচ্ছে ১৬ থেকে ১৭ শতাংশ সুদে।

বেসরকারি মিউচুয়াল ট্রাস্ট ব্যাংক এক বছর মেয়াদি আমানতে সুদ দিচ্ছে ৮ থেকে ১১ শতাংশ হারে। অপরদিকে ঋণ বিতরণ করছে ১০ থেকে ১৩ শতাংশ হারে। ট্রেডিং ফাইন্যান্সে সাড়ে ১৪ শতাংশ আর ক্রেডিট কার্ডে ব্যাংকটির সুদহার নির্ধারিত আছে সাড়ে ২৩ থেকে সাড়ে ২৬ শতাংশ পর্যন্ত।

এক বছর মেয়াদি আমানতে ৮ দশমিক ৭৫ শতাংশ থেকে সাড়ে ৯ শতাংশ মুনাফা দিচ্ছে বেসরকারি খাতের এক্সিম ব্যাংক। এর বিপরীতে ঋণ দিচ্ছে ১৩ থেকে ১৬ শতাংশ হারে। ক্রেডিট কার্ডে ব্যাংকটির সুদহার নির্ধারিত আছে ২৪ শতাংশ। অথচ ২০১৭ সালে ব্যাংকটি আমানতে ৬ শতাংশের কম মুনাফা দিয়েছে, ঋণ বিতরণ করেছে ১০ শতাংশের নিচে।

প্রিমিয়ার ব্যাংক আমানতে সুদ দিচ্ছে ৮ শতাংশ আর ঋণের সুদ নিচ্ছে ১২ শতাংশ হারে। চতুর্থ প্রজন্মের পদ্মা ব্যাংক (সাবেক ফারমার্স ব্যাংক) ১০ শতাংশের ওপরে আমানত সংগ্রহ করছে। ব্যাংকটির এক বছর মেয়াদি আমানতের সুদ দিচ্ছে ১০ দশমিক ৫০ শতাংশ এবং ঋণ বিতরণ করছে ১৫ দশমিক ৫০ শতাংশ হারে।

তৈরি পোশাক খাতের উদ্যোক্তা ও বিজিএমইএ’র সাবেক সভাপতি সিদ্দিকুর রহমান বলেন, ব্যাংকগুলো যে সুদ নিচ্ছে এ হারে ব্যবসা করা কঠিন। বেশ কিছুদিন ধরে শুনছি সুদহার সিঙ্গেল ডিজিটে নামবে। কিন্তু উল্টো বাড়ছে।

‘কীভাবে ব্যাংক সিঙ্গেল ডিজিটে আনবে। এখন তো আমানতই নিচ্ছে ১০ শতাংশের ওপরে। তাহলে কীভাবে সুদহার সিঙ্গেল ডিজিটে নামাবে’- প্রশ্ন রাখেন তিনি।

সিদ্দিকুর রহমান আরও বলেন, ‘অনেক ব্যাংক আমাদের ফোন করে অফার দিচ্ছে। বলছে, আমানত রাখেন ১১, ১২ শতাংশ ইন্টারেস্ট দেব। যদি আমানতের ওপর ১১, ১২ শতাংশ হারে সুদ দেয়; তাহলে সুদহার কীভাবে কমাবে? আর ব্যবসায় এমন কোনো লাভ নেই যে ১৩, ১৪ শতাংশ হারে সুদে ঋণ নিয়ে ওই টাকা ফেরত দেব।’

‘এ বিষয়ে সরকারকে আমরা বলেছি, বিশ্ববাজারে প্রতিযোগিতায় টিকে থাকতে হলে অবশ্যই সহনীয় পর্যায়ে সুদহার নামাতে হবে।’

এদিকে গত বছরের শুরুর দিকে ব্যাংকের সুদহার বাড়তে থাকায় তা কমানোর উদ্যোগ নেয় সরকারসহ সংশ্লিষ্টরা। সিঙ্গেল ডিজিটে ঋণ দেয়ার ঘোষণা দেয় ব্যাংক উদ্যোক্তা পরিচালকদের সংগঠন ‘বিএবি’। এজন্য গত বছর ব্যাংকগুলোকে একের পর এক সুবিধা দেয় সরকার। কিন্তু কাজের কাজ কিছুই হয়নি। ঘোষণার মধ্যেই সীমাবদ্ধ থেকে যায় ব্যাংকের সুদহার। এ নিয়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা নিজেও ক্ষোভ প্রকাশ করেন।

সম্প্রতি এক অনুষ্ঠানে তিনি বলেন, শিল্পায়নের সবচেয়ে বড় বাধা ব্যাংক ঋণের উচ্চ সুদ। সরকারের পক্ষ থেকে বিভিন্ন সুযোগ-সুবিধা দেয়ার পরও সুদহার না কমিয়ে উল্টো বাড়িয়ে ১৬ শতাংশ সুদে ঋণ বিতরণের কারণ জানতে চান তিনি।

সুদহার বৃদ্ধির কারণ হিসেবে ব্যাংকাররা বলছেন, যে পরিমাণ আমানত আসছে, ঋণের চাহিদা রয়েছে তার চেয়ে বেশি। সঞ্চয়পত্রের সুদহার রয়েছে দুই অঙ্কে। খেলাপি ঋণ, পরিচালন ব্যয় বাড়া, ব্যাংকগুলোর ঋণ-আমানত অনুপাত বা এডিআর কমানোর চাপও রয়েছে। সব মিলিয়ে ব্যাংকগুলোর সুদহার বাড়ছে।

সুদের হার বাড়া প্রসঙ্গে ব্যাংকগুলোর প্রধান নির্বাহীদের সংগঠন অ্যাসোসিয়েশন অব ব্যাংকার্স, বাংলাদেশের (এবিবি) নতুন চেয়ারম্যান ও ঢাকা ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক সৈয়দ মাহবুবুর রহমান বলেন, আমানত সংকটের কারণে সুদহার কাঙ্ক্ষিত পর্যায়ে নামানো যাচ্ছে না।

সরকারপ্রধানের নির্দেশনা সত্ত্বেও সুদের হার না কমে উল্টো বাড়ছে- এর কারণ জানতে চাইলে তিনি বলেন, সিঙ্গেল ডিজিটে সুদের হার নামিয়ে আনতে চেষ্টা চলছে। অনেক ক্ষেত্রে কমানো হয়েছে। তবে বাস্তবিক কারণে পুরোপুরি কমানো যায়নি। এর অন্যতম কারণ হচ্ছে, আমানতের সংকট। এছাড়া খেলাপি ঋণ বাড়ায় প্রভিশন রাখতে গিয়ে অর্থ সংকটে পড়ছে ব্যাংকগুলো। সব মিলিয়ে সুদের হার কমাতে সমস্যা হচ্ছে। তবে চেষ্টা চলছে, তারল্য সংকট কমলে সুদের হার কমে যাবে।

তিনি আরও বলেন, আমাদের দেশের ব্যবসায়ীরা ব্যাংক ঋণের ওপর নির্ভরশীল। এটি থেকে বের হতে হবে। এজন্য বন্ডমার্কেট, পুঁজিবাজার উন্নত করতে হবে। একই সঙ্গে সঞ্চয়পত্রের সুদের হার যৌক্তিক পর্যায়ে আনতে হবে।

এদিকে প্রাক-বাজেট আলোচনায় অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল বলেন, ব্যাংক খাত এখন দুরবস্থায় রয়েছে। খেলাপি ঋণ বাড়ছে। ঋণ নিয়ে ফেরত দিতে পারছে না গ্রাহক। কারণ এত বেশি সুদে ব্যবসায়ীরা কীভাবে ঋণ ফেরত দেবে? ১৫, ১৬ শতাংশ সুদে ঋণ নিয়ে কখনই ব্যবসা করা সম্ভব নয়। সুদের ওপর নতুন করে আরও সুদ আরোপ হচ্ছে।