নানারকম দুর্নীতির হোতা রিজেন্ট হাসপাতালের চেয়ারম্যান শাহেদ

নিজস্ব প্রতিবেদক:  করোনা টেস্টের ভুয়া রিপোর্ট প্রদান, অর্থ আত্মসাতসহ প্রতারণার অভিযোগে রিজেন্ট গ্রুপ ও রিজেন্ট হাসপাতাল লিমিটেডের চেয়ারম্যান শাহেদ করিম ওরফে শাহেদকে অবশেষে গ্রেফতার করেছে র‌্যাব। বুধবার সাতক্ষীরার সীমান্ত এলাকা থেকে তাকে গ্রেফতার করা হয়। এর আগে গত সপ্তাহ থেকে প্রকাশ্যে আসে সাহেদের পৃষ্ঠপোষকতায় রিজেন্ট হাসপাতালের একের পর এক অনিয়ম।

রিজেন্টের করোনা পরীক্ষার সব রিপোর্টই ভুয়া:
রিজেন্ট হাসপাতালের করোনার ১০ হাজার নমুনা পরীক্ষার মধ্যে ৬ হাজারই ভুয়া রিপোর্ট দেয়া হয়েছে বলে জানিয়েছেন র‌্যাবের মহাপরিচালক (ডিজি) চৌধুরী আবদুল্লাহ আল মামুন। গতকাল বুধবার বিকালে র‌্যাব সদর দফতরে সংবাদ সম্মেলনে তিনি এ তথ্য জানান। র‌্যাবের মহাপরিচালক বলেন, সে (শাহেদ) করোনা পরীক্ষার রিপোর্টের নামে প্রতারণা করছিল। এখন পর্যন্ত ১০ হাজারের অধিক করোনা পরীক্ষা করে ৬ হাজার ভুয়া রিপোর্ট দিয়েছে সাহেদের প্রতিষ্ঠান।

তিনি বলেন, বিনামূল্যে পরীক্ষা করার কথা থাকলেও ৩৫০০ থেকে ৪০০০ টাকা করে নেয়া হতো এবং পুনরায় পরীক্ষার জন্য ১০০০ গ্রহণ করতো। আইসিইউতে ভর্তি করে মোটা অঙ্কের টাকা দাবি করতো। একদিকে রোগীর কাছ থেকে টাকা হাতিয়ে নিয়েছে, আরেক দিকে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ে বিলও জমা দিয়েছে সাহেদের হাসপাতাল রিজেন্ট।

জাল টাকায় ঋণ পরিশোধ করতো শাহেদ:
রিজেন্ট হাসপাতালের চেয়ারম্যান শাহেদকে ইন্টারোগেশন সেলে জিজ্ঞাসাবাদ শেষে উত্তরার ১১ নম্বর সেক্টরে একটি বাসায় অভিযান চালিয়েছে র‌্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ন (র‌্যাব)। সেটি সাহেদের গোপন বাসা বলে জানিয়েছে র‌্যাব। সেখানে থেকে বিপুল পরিমাণ জাল টাকা উদ্ধার করা হয়েছে। যে টাকা দিয়ে বিভিন্ন মানুষের কাছ থেকে নেওয়া ঋণ পরিশোধ করতো শাহেদ। গতকাল র‌্যাব সদর দফতর থেকে শাহেদকে নিয়ে উত্তরার ১১ নম্বর সেক্টরের ২০ নম্বর রোডের ৬২ নম্বর বাড়িতে অভিযান চালায় র‌্যাব।

র‌্যাবের গণমাধ্যম শাখার পরিচালক লেফটেন্যান্ট কর্নেল আশিক বিল্লাহ সাংবাদিকদের বলেন, ‘সাহেদের দেওয়া তথ্য মতে, ওই গোপন বাসা থেকে যে জাল টাকা উদ্ধার করা হয়েছে, তা দিয়ে সে ঋণ পরিশোধ করতো। ভুক্তভোগীরা দীর্ঘদিন ঘুরেও যখন টাকা পাচ্ছিল না তখন এসব টাকা পেয়ে অনেকই খুশি হতো।

তিনি বলেন, তবে যখন এসব টাকা নিয়ে বিপাকে পড়তো, বুঝতো জালটাকা- তখন আবারও ভুক্তভোগীরা সাহেদের কাছে যেতেন। এরপর শাহেদ বলতো, আমি আপনাদের ঋণের টাকা পরিশোধ করেছি, আর এখন বলছে এসব টাকা জাল। এখন কী করবেন, যান মামলা করেন আমার নামে।

পাওনা টাকা চাইলেই মেরে ফেলার হুমকি:
রিজেন্ট গ্রুপের চেয়ারম্যান সাহেদের গ্রেফতারের খবর পেয়ে তার উত্তরা কার্যালয়ে ছুটছে পাওনাদাররা। যদিও এর আগে সাহেদের কাছে পাওনা টাকা চাইলে হত্যার হুমকি দিত বলে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কাছে অভিযোগ করছেন পাওনাদাররা।

এক নারী বলেন, ‘স্বামী হাবিবুর রহমানের সঙ্গে পরিচয় থাকার সুবাদে ২০০৮ সালে শাহেদকে পাঁচ লাখ টাকা ঋণ দেয়া হয়। অফিস স্টাফদের বেতন দিতে তিনি এ টাকা ঋণ নেন। সেই টাকার পরিবর্তে শাহেদ একটি গাড়ি দিয়েছিল, তবে সেটি ছিল চোরাই গাড়ি। পরে ২০০৯ সালে গাড়িটি জব্দ করে শাহবাগ থানা পুলিশ। শাহেদ এ গাড়ি চুরির মামলায় গ্রেফতারও হন। পরে তাকে আর খুঁজে পাওয়া যাচ্ছিল না। দীর্ঘ দিন পর ২০১৮ সালে তার সঙ্গে রিজেন্ট গ্রুপের অফিসে দেখা করি। তখন টাকা চাইলে হত্যার হুমকি দেয় শাহেদ।’

সিলেটের জৈন্তাপুরের পাথর ব্যবসায়ী শামসুল মাওলা জানান, তার কাছ থেকে শাহেদ প্রায় ৩০ লাখ টাকার পাথর কেনেন রিজেন্ট গ্রুপের নামে। বছর পার হলেও এক টাকাও পরিশোধ করেনি শাহেদ। একর্যায়ে তার অফিসে এসে টাকা চাইলে মেরে ফেলার হুমকি দেয়।

এ বিষয়ে র‌্যাবের নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট সারোয়ার আলম বলেন, ‘সাহেদের কাছে টাকা পাবেন এমন অনেকেই আমাদের কাছে অভিযোগ করেছে। তদন্তের পর এ বিষয়ে জানানো হবে।’

প্রতারণার বেশ কিছু চাঞ্চল্যকর তথ্য দিলো ‘আসল রিজেন্ট গ্রুপ’:
রিজেন্ট গ্রুপের ফেসবুক পেইজে দেয়া এক ভিডিও বার্তায়, প্রতারণা মামলায় গ্রেপ্তার শাহেদকে নিয়ে চাঞ্চল্যকার তথ্য দিয়েছেন ‘আসল’ রিজেন্ট গ্রুপের উপ-ব্যবস্থাপনা পরিচালক ব্যারিস্টার তারেক আকবর খন্দকার।

ব্যারিস্টার তারেক আকবর বলেন, ১৯৮১ সালে প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পর থেকে আজ পর্যন্ত সুনামের সাথে ব্যবসা করে আসছে রিজেন্ট গ্রুপ। এটি সরকারের নিবন্ধিত একটি কোম্পানি। কিন্তু সম্প্রতি একটি ফেইক রিজেন্ট গ্রুপের নাম শোনা যাচ্ছে। যারা উত্তরার রিজেন্ট হাসপাতালের মালিক। যাদের হেড অফিস উত্তরায়। তাদের ওয়েবসাইটে আমাদের বিভিন্ন অঙ্গ প্রতিষ্ঠানের নাম দেয়া হয়েছে।

তিনি আরো বলেন, গুলশান সোসাইটির একটি প্রোগ্রামে দুইজন লোক এসে আমাকে বলে তারা রিজেন্ট গ্রুপের ডিরেক্টর। অথচ আমি তাদেরকে চিনি না। কথাবার্তায় জানতে পারি ডিরেক্টর হওয়ার জন্য তারা দুই কোটি করে টাকা দিয়েছেন ফেক রিজেন্ট গ্রুপের চেয়ারম্যান শাহেদকে। কিন্তু আজ পর্যন্ত তারা কোনো কাগজপত্র পাননি। এছাড়া ২০১৫ সালের ফেক রিজেন্ট গ্রুপের মালিক শাহেদ কক্সবাজারের ইনানীতে আমাদের জায়গার সামনে দাঁড়িয়ে একটি ছবি তোলেন। পরে ব্যক্তিগত ফেসবুকে সেই ছবি আপলোড করে লেখেন ‘প্রজেক্ট ভিজিট’। নিশ্চয় কু-উদ্দেশ্য না থাকলে অন্যের জমিতে দাঁড়িয়ে ছবি তুলে তিনি ‘প্রজেক্ট ভিজিট’ লিখতেন না। এতে আমি বুঝলাম এসব বাটপারি করেই তারা বিজনেস চালায়।

তারেক আকবর বলেন, আমরা ২০১৫ সালে উত্তরার সেই ফেক রিজেন্ট গ্রুপকে একটি লিগ্যাল নোটিশ পাঠাই। সেখানে আমাদের রিজেন্ট গ্রুপের নাম ব্যবহারের জন্য আমরা দুইশ’ কোটি টাকার মানহানি মামলার কথা বলি। তাদেরকে বলা হয় যেন আমাদের নাম ব্যবহার না করে।