দ্বি-মুখী আচরণ ভারতের: আমদানিতে ‘হ্যাঁ’, রফতানিতে ‘না’

নিজস্ব প্রতিবেদক: লকডাউনের কারণে দীর্ঘদিন বন্ধ ছিল আমদানি-রফতানি কার্যক্রম। সম্প্রতি স্থলবন্দরগুলো খুলে দেয়া হয়েছে। ভারত থেকে পণ্য আমদানি হচ্ছে। প্রতিদিন আসছে শত শত ট্রাক। তবে বাংলাদেশ থেকে বেশিরভাগ বন্দর দিয়ে ট্রাক ঢুকতে দিচ্ছে না ভারত। ফলে আমদানি কার্যক্রম স্বাভাবিক থাকলেও ব্যাহত হচ্ছে রফতানি। বাড়ছে বাণিজ্য ঘাটতি। ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন রফতানিকারকরা। বৈদেশিক আয় থেকে বঞ্চিত হচ্ছে দেশ।

খাতসংশ্লিষ্টরা বলছেন, লকডাউনের কারণে দীর্ঘ আড়াই মাস বন্ধ থাকার পর জুনের প্রথম সপ্তাহে স্থলবন্দরগুলো খুলে দেয়া হয়েছে। তবে বেশিরভাগ বন্দরে আমদানি হলেও রফতানি কার্যক্রম বন্ধ রেখেছে পাশ্ববর্তী দেশ ভারত। তারা রফতানি করছে কিন্তু বাংলাদেশের ব্যবসায়ীদের পণ্য রফতানির অনুমতি দিচ্ছে না।

জানা গেছে, লকডাউনের কারণে গত ২৩ মার্চ বেনাপোল স্থলবন্দর দিয়ে আমদানি-রফতানি বন্ধ হয়ে যায়। ভারতের কেন্দ্রীয় সরকার গত ২৪ এপ্রিল আমদানি-রফতানি চালুর নির্দেশনা দিলেও পশ্চিমবঙ্গ সরকারের অনুমতি না থাকায় দীর্ঘদিন সড়কপথে বন্ধ ছিল বাণিজ্য। এখন বন্দর খুলে দেয়া হয়েছে, তবে আমদানি হলেও বন্ধ রয়েছে রফতানি কার্যক্রম। এ নিয়ে ব্যবসায়ী, বন্দর কর্তৃপক্ষ ও সরকারের বিভিন্ন মন্ত্রণালয় থেকে বারবার বলা হলেও কোনো সমাধান আসছে না।

দুই দেশের ব্যবসায়ীরা জানায়, ভারতের কেন্দ্রীয় সরকার আমদানি-রফতানির অনুমতি দিলেও রাজ্য সরকারের একক সিদ্ধান্তের কারণে রফতানি কার্যক্রম স্বাভাবিক হচ্ছে না। সরকারের উচ্চপর্যায় থেকে ভারতের রাজ্য সরকারের ওপর চাপ সৃষ্টি না করলে এর সুরাহা হবে না।

রফতানিকারকরা বলছেন, তিন মাস ধরে রফতানি বন্ধ। পণ্যের রফতানি অর্ডার আসছে। কিন্তু পাঠানো যাচ্ছে না। রফতানির জন্য তৈরি করা কোটি কোটি টাকা মূল্যের পণ্য নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। ব্যবসা-বাণিজ্য বন্ধ থাকায় বড় ক্ষতির মুখে পড়েছেন তারা। এভাবে চলতে থাকলে ব্যবসা বন্ধ করে দেয়া ছাড়া উপায় থাকবে না।

বাংলাদেশ স্থলবন্দর কর্তৃপক্ষ চেয়ারম্যান তপন কুমার চক্রবর্তী বলেন, ভারতীয় কর্তৃপক্ষ আমাদের রফতানি পণ্য প্রবেশের অনুমতি দিচ্ছে না। আমরা বিভিন্ন মাধ্যমে তাদের একাধিকবার বলেছি, রফতানি স্বাভাবিক রাখতে। কিন্তু লকডাউনের কারণে তারা খুলে দিচ্ছে না। রফতানির অনুমতিও দিচ্ছে না। লকডাউনের কারণে সেখানে লকডাউনের সময় বাড়িয়ে ৩১ জুলাই করেছে।
তিনি আরও বলেন, বাংলাবান্ধাসহ কয়েকটি স্থলবন্দর দিয়ে কিছু গাড়ি ভারতে যাচ্ছে; তবে সেটা খুবই সামান্য। আমরা পুরোপুরি সচলের জন্য তাদের বলেছি। বাংলাদেশ অংশে আমদানি-রফতানির কোনো সমস্যা নেই। সমস্যা হচ্ছে ভারতের কাস্টমস, তারা যদি অনুমতি দেয় তাহলে আমরা গাড়ি ছেড়ে দেব।

ব্যবসায়ীদের শীর্ষ সংগঠন এফবিসিসিআই সভাপতি শেখ ফজলে ফাহিম বলেন, স্থলবন্দরগুলোতে রফতানিতে জটিলতা দেখা দিয়েছে। গভর্নমেন্ট টু গভর্নমেন্ট আলোচনা চলছে। আমরা এ বিষয়ে অবগত আছি। গভর্নমেন্ট লেভেলে বিষয়টি দেখভাল হচ্ছে। আমরা এর আপডেট খবর নিচ্ছি। এছাড়া যে ট্রেনগুলো ভারত থেকে মাল নিয়ে আসে সেখানে নতুন কাস্টম হাউজ বসানোর প্রক্রিয়া চলছে।

‘এছাড়া বেনাপোল, হিলি বন্দরে আমাদের কিছু ট্রাক আটকে আছে। আমরা বিষয়টি নিয়ে কাজ করছি। বেনাপোল দিয়ে ইতোমধ্যে কার্যক্রম শুরু হয়েছে। আশা করছি, শিগগিরই সব বন্দরে পুরোপুরি কার্যক্রম শুরু হবে।’

‘স্থলপথে ভারতে পণ্য রফতানিতে জটিলতা হচ্ছে’ বিষয়টি স্বীকার করে বাণিজ্য সচিব ড. জাফর উদ্দিন বলেন, আমরা বিষয়টি নিয়ে কাজ করছি। দুই দেশের কূটনৈতিক পর্যায়ে সমস্যা সমাধানে আলোচনা চলছে। আশা করছি শিগগিরই সুরাহা হবে।
বাংলাদেশ-ভারতের স্থলবন্দরগুলোর মধ্যে সবচেয়ে বেশি আমদানি-রফতানি হয় বেনাপোল বন্দর দিয়ে। চলতি মাসের শুরুতে বেনাপোল দিয়ে আমদানি বাণিজ্য চালু হলেও গত তিন মাস ধরে রফতানি বাণিজ্য বন্ধ। কাস্টমস, বন্দর ও ব্যবসায়ীরা ভারতে স্থানীয়পর্যায়ে কয়েক দফা বৈঠক করলেও রফতানি বাণিজ্য সচল হয়নি। ফলে এ বন্দর দিয়ে বাণিজ্য ঘাটতির পরিমাণ দাঁড়িয়েছে দুই হাজার কোটি টাকা।

জানা গেছে, দেশে স্থলপথে যে রফতানি হয় তার ৭০ শতাংশ হয় বেনাপোল বন্দর দিয়ে। প্রতি বছর এ বন্দর দিয়ে প্রায় ১০ হাজার কোটি টাকা মূল্যের নয় হাজার টন বাংলাদেশি পণ্য ভারতে রফতানি হয়। লকডাউন সংক্রমণের কারণে গত ২২ মার্চ থেকে বেনাপোল বন্দর দিয়ে আমদানি-রফতানি বাণিজ্য বন্ধ হয়ে যায়। গত ৭ জুন এ পথে ভারতীয় পণ্যের আমদানি বাণিজ্য শুরু হলেও ভারতীয়রা বাংলাদেশের রফতানি বাণিজ্য বন্ধ রেখেছে।

দেশের স্থলবন্দরগুলোর মধ্যে রয়েছে- বেনাপোল, হিলি, আখাউড়া, ভোমরা, সোনামসজিদ, বাংলাবান্ধা, হালুয়াঘাট, বিবিরবাজার, টেকনাফ, বুড়িমারী ও তামাবিল স্থলবন্দর। এসব বন্দর দিয়ে শুধু ভারত থেকে ছয় কোটি ৬৭ লাখ টন পণ্য আমদানি হয়।
রফতানি উন্নয়ন ব্যুরোর (ইপিবির) পরিসংখ্যান অনুযায়ী, বাংলাদেশের মোট বৈদেশিক বাণিজ্যের প্রায় ১০ শতাংশ এককভাবে ভারতের সঙ্গে হয়। ২০১৮-১৯ অর্থবছরে দুই দেশের মোট বাণিজ্যের পরিমাণ ৮৯০ কোটি ডলার। যার সিংহভাগ পণ্য ভারত থেকে বাংলাদেশে এসেছে। এর মধ্যে বাংলাদেশ থেকে রফতানি হয় মাত্র ১২৫ কোটি ডলারের পণ্য। অর্থাৎ দু’দেশের মধ্যে বাণিজ্য ঘাটতির পরিমাণ ৭৬৫ কোটি ডলার। চলমান সংকটে ভারতে রফতানি বন্ধ থাকায় বাণিজ্য ঘাটতি ব্যাপক হারে বেড়ে যাবে বলে শঙ্কা প্রকাশ করেছেন সংশ্লিষ্টরা।