চাকরির বাজারে বিদেশীদের আধিপত্য, চলে যাচ্ছে হাজার হাজার কোটি টাকা

নিউজ নাইন২৪ডটকম, ডেস্ক: বাংলাদেশে চাকরির বাজারে ভারতীয়সহ বিদেশীদের আধিপত্য বেড়েই চলছে। এতে দেশ থেকে প্রতি বছর চলে যাচ্ছে হাজার হাজার কোটি টাকা। এদিকে একটি সাধারণ চাকরির জন্য বহু বাংলাদেশী তিন পুরুষের ভিটেমাটি বিক্রি করে বিদেশ পাড়ি দিচ্ছে। অনেকে জীবনে ঝুঁকি নিতেও পিছপা হচ্ছে না। অথচ বাংলাদেশেই কাজ করছে কয়েক লাখ বিদেশী, যাদের বেশিরভাগই অবৈধ।

একটি জাতীয় দৈনিকের এক প্রতিবেদনে বলা হয়, দেশে দক্ষ ও যোগ্য জনশক্তি থাকতেও কোনো কোনো খাতে চাকরির ক্ষেত্রে বিদেশীদের অগ্রাধিকার দেয়া হচ্ছে। সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের নিয়মনীতি লঙ্ঘন করেই বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে বিদেশী কর্মী নিয়োগ চলছে। এ প্রবণতা শুধু বিদেশী কোম্পানি বা সংস্থায়ই নয়, খোদ দেশীয় প্রতিষ্ঠানগুলোতেও এখন বিদেশী কর্মী রাখা রীতিমতো ফ্যাশনে পরিণত হয়েছে।

বিভিন্ন দেশের নাগরিকরা বৈধ-অবৈধভাবে এদেশে জাঁকিয়ে বসে চাকরি করে যাচ্ছে; পকেটে পুরছে লাখ লাখ টাকার বেতন; আর এ টাকার বেশির ভাগই অবৈধ পথে নিজের দেশে পাঠাচ্ছে। আবার ওইসব প্রতিষ্ঠানে দেশের যেসব নাগরিকের চাকরি মিলছে, তারা অনেক কম বেতনে বিদেশী বসের অধীনে, এমনকি বিদেশী সহকর্মীর চেয়েও কম বেতনে চাকরি করে যাচ্ছেন। এ যেন ‘নিজ দেশে পরবাসী’ অবস্থা। অবৈধ বিদেশী কর্মীদের ব্যাপারে সরকারের সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষগুলোরও কোনো নজরদারি নেই।

দৈনিকটি জানায়, বাংলাদেশে বিভিন্ন ধরনের চাকরিতে ভারতীয়দের প্রাধান্য সবচেয়ে বেশি। এর আগে মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোর বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের মধ্যম ও মাঝারি পদে ভারতীয়দের জয়জয়কার ছিল। এটা ঠেকাতে মধ্যপ্রাচ্যের বহু দেশে এখন ভারত থেকে কর্মী নেওয়া বন্ধ করা হয়েছে। কিন্তু বাংলাদেশের বিভিন্ন সেক্টরে ভারতীয়দের আধিপত্য দিন দিন বাড়ছে। এর পরই রয়েছে শ্রীলঙ্কা, পাকিস্তান, থাইল্যান্ড, ফিলিপাইনসহ আফ্রিকা, ইউরোপ-আমেরিকার ৫৫টি দেশের নাগরিক।

নিয়ম অনুযায়ী, বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে কর্মী নিয়োগের ক্ষেত্রে বিনিয়োগ বোর্ড থেকে নিবন্ধন নেওয়ার বাধ্যবাধকতা রয়েছে। ইপিজেডে বিদেশী কর্মী নিয়োগ করতে হলে অনুমোদন নিতে হয় বাংলাদেশ রফতানী প্রক্রিয়াকরণ অঞ্চল (বেপজা) থেকে। এনজিওতে বিদেশী কর্মী নিয়োগের ক্ষেত্রে অনুমতি নিতে হয় এনজিও ব্যুরো থেকে।

জানা গেছে, বাংলাদেশে আটটি রফতানী প্রক্রিয়াকরণ অঞ্চল বা ইপিজেডে এখন অনুমতি নিয়ে বৈধভাবে কাজ করেন তিন হাজারের মতো বিদেশী। বিনিয়োগ বোর্ডের অনুমতি নিয়ে দেশে কাজ করেন ১৩ হাজার বিদেশী কর্মী। আর এনজিও ব্যুরোর অনুমতি নিয়ে কাজ করা বিদেশী কর্মীর সংখ্যা ৫০০। সব মিলিয়ে সাড়ে ১৬ হাজার বিদেশী কর্মী সরকারের সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানগুলো থেকে অনুমতি নিয়ে বাংলাদেশে বৈধভাবে কাজ করছেন। তবে বাস্তবে এ সংখ্যা বহুগুণ বেশি।

বাংলাদেশে আসলে কতসংখ্যক বিদেশী নাগরিক কাজ করেন, তার সঠিক তথ্য সরকারের কোনো বিভাগের হাতেই নেই। বেসরকারি গবেষণা সংস্থা সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) ২০১৫ সালের এক গবেষণায় দেখা গেছে, প্রায় পাঁচ লাখ ভারতীয় নাগরিক বাংলাদেশে কাজ করেন। তারা তাদের দেশে এক বছরে ৩ দশমিক ৭৬ বিলিয়ন ডলার পাঠিয়েছেন, যা বাংলাদেশী মুদ্রায় প্রায় ৩০ হাজার কোটি টাকার সমান। বাংলাদেশ ভারতে পঞ্চম রেমিট্যান্স প্রদানকারী দেশ হিসেবে বিবেচিত হয়। তাই সহজেই অনুমান করা যায়, বিনিয়োগ বোর্ড থেকে যেসব ভারতীয় কর্মী ওয়ার্ক পারমিট নিয়েছেন, তার বাইরে বহুগুণ বেশি রয়েছেন, যারা অবৈধভাবে বাংলাদেশে আছেন। আর তাদের অর্জিত অর্থ অবৈধ পথে হুন্ডির মাধ্যমেই পাচার করা হয়ে থাকে।

জানা গেছে, ভ্রমণ ভিসায় বাংলাদেশে আসেন ভারত, শ্রীলঙ্কা, পাকিস্তান ও থাইল্যান্ডের নাগরিকরা। এরপর তারা নির্দিষ্ট প্রতিষ্ঠানে কাজ করে ভিসার মেয়াদ শেষের আগেই চলে যান। নতুন করে আবার ভ্রমণ ভিসা নিয়ে বাংলাদেশে আসেন। নিয়োগদাতা প্রতিষ্ঠান এসব বিদেশী কর্মীর বেতন পরিশোধ করে রাজস্বমুক্ত বিভিন্ন খাত থেকে। বিদেশী কর্মীরা ডলার করে টাকা নিয়ে যান নিজের দেশে।

বিভিন্ন সূত্রে জানা গেছে, সব থেকে বেশি বিদেশী কর্মী কাজ করেন পোশাক খাতে। পোশাক খাতের প্রতিষ্ঠান যেমন গার্মেন্ট, কম্পোজিট টেক্সটাইল মিল, ওভেন ও নিটওয়্যার ইন্ডাস্ট্রি, সোয়েটার ফ্যাক্টরি, বায়িং হাউস, মার্চেন্ডাইজিং কোম্পানি মিলিয়ে প্রায় ১০ লাখ বিদেশী কাজ করেন এ দেশে, এমন তথ্য বিভিন্ন সময় শ্রমিক নেতাদের সূত্রে বলা হয়েছে। বিভিন্ন বহুজাতিক কোম্পানি, বেসরকারি বিদ্যুৎকেন্দ্র, আন্তর্জাতিক ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান, ফ্যাশন হাউস, খাদ্য উৎপাদন ও বিপণনকারী প্রতিষ্ঠান, মোবাইল ফোন কম্পানি, পোল্ট্রি খাদ্য উৎপাদক প্রতিষ্ঠান, চামড়াজাত প্রতিষ্ঠান, বহুজাতিক তেল-গ্যাস কোম্পানি, মিডিয়া রিসার্চ প্রতিষ্ঠান ও বিজ্ঞাপনি সংস্থাসহ সাধারণ ফার্নিচারের দোকানেও বিদেশীরা কাজ করছেন।

বিনিয়োগ বোর্ডের নির্বাহী সদস্য নাভাস চন্দ্র মন্ডল বলেছে, ‘বিনিয়োগ বোর্ড যেসব কর্মীর ওয়ার্ক পারমিট দেয়, আমরা শুধু তাঁদের ব্যাপারেই নজরদারি করতে পারি। এর বাইরে যাঁরা আসেন তাঁদের বিষয়ে আমাদের কাছে কোনো তথ্য নেই।’তিনি বলেন, বিনিয়োগ বোর্ডের কাছ থেকে ওয়ার্ক পারমিট নিয়ে ১২ থেকে ১৩ হাজার বিদেশী নাগরিক কাজ করছেন। এটি প্রাথমিক তথ্য। বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে কতসংখ্যক বিদেশী কাজ করেন, তা বের করার জন্য বিনিয়োগ বোর্ড অনুসন্ধান করছে। আগামী সপ্তাহের মধ্যেই চূড়ান্ত সংখ্যা পাওয়া যাবে বলে জানান তিনি।

বাংলাদেশে কতসংখ্যক বিদেশী নাগরিক অনুমতি নিয়ে বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থায় কাজ করছেন জানতে চাইলে এনজিও ব্যুরোর পরিচালক (যুগ্ম সচিব) কে এম আবদুস সালাম বলেন, ‘৫০০’র মতো বিদেশী নাগরিক আমাদের কাছ থেকে অনুমোদন নিয়ে কাজ করছেন।’

প্রকৃতপক্ষে কত বিদেশী দেশে আছেন তা কোনো সংস্থাই জানে না। গত ২৮ জানুয়ারি বিনিয়োগ বোর্ড, এনজিও ব্যুরো ও বেপজাকে দেওয়া এক চিঠিতে বাংলাদেশে অবস্থানরত বিদেশী নাগরিকদের তালিকা পাঠাতে অনুরোধ করেছে এনবিআর। বিষয়টি ‘অতি জরুরি’ উলেøখ করা হলেও এমন তথ্য কত দিনে পাঠাতে হবে, চিঠিতে তা উলেøখ করা হয়নি।

বিনিয়োগ বোর্ডের নিয়ম অনুযায়ী, দেশি বা বিদেশী কোনো শিল্পোদ্যোক্তা যদি তার প্রতিষ্ঠানে কর্মী নিয়োগ দিতে চান, তাহলে তাকে অগ্রাধিকার দেওয়ার কথা দেশের জনশক্তিকে। সেটি যদি পাওয়া না যায়, তাহলে বিদেশী নাগরিক আনা যেতে পারে। কিন্তু শিল্পোদ্যোক্তারা এসব না মেনেই বিদেশী নাগরিক নিয়োগ দেন।

বিনিয়োগ বোর্ডের আইনে আরো বলা আছে, কোনো শিল্পপ্রতিষ্ঠানে একজন বিদেশী নাগরিক নিয়োগ দিলে তার বিপরীতে ২০ জন দেশীয় কর্মী নিয়োগ দিতে হবে বা থাকতে হবে। আর প্রতিষ্ঠানটি যদি বায়িং হাউস বা বাণিজ্যিক অফিস হয়, সেখানে একজন বিদেশী নাগরিক নিয়োগ দিলে তার বিপরীতে পাঁচজন দেশীয় কর্মী নিয়োগ দিতে হবে বা থাকতে হবে। তবে তেল-গ্যাস উত্তোলনকারী বহুজাতিক বিদেশী কম্পানি হলে সে ক্ষেত্রে এ শর্ত শিথিল হবে। এই সুযোগে যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক তেল-গ্যাস কম্পানি শেভরনে বহু বিদেশী কর্মী কাজ করেন। আর অন্যান্য দেশী ও বিদেশী প্রতিষ্ঠান এসব শর্ত মানে না। উদ্যোক্তাদের যুক্তি, দেশে দক্ষ ও কারিগরি জ্ঞানসম্পন্ন জনশক্তি নেই।

আরো নিয়ম আছে, যে প্রতিষ্ঠানে বিদেশীরা কাজ করবেন, এ দেশের শ্রমবাজারের দক্ষতা তৈরি হলে ক্রমান্বয়ে তাঁদের নিজ দেশে পাঠিয়ে দিতে হবে। আর সেই শূন্যস্থান দেশীয় লোকবল দিয়ে পূরণ করতে হবে। তবে এসব সরকারের আইন ও কাগজের মধ্যেই সীমাবদ্ধ। বা¯Íবে বহু বিদেশী কোম্পানি সাধারণ কাজের জন্যও বিদেশ থেকে লোক আনছে। বছরের পর বছর এসব বিদেশী বাংলাদেশে চাকরি করছেন। ওই সব কোম্পানির উচ্চ পদে সবাই বিদেশী। সেখানে বাংলাদেশীদের নিয়োগই হয় না। মুরগি, ডিম, মুরগির বাচ্চা, মুরগির খাদ্য উৎপাদনকারী একটি বড় প্রতিষ্ঠানে ড. শিবাজি নামে একজন ভারতীয় আড়াই লাখ টাকার বেশি বেতনে চাকরি করেন। ভেটেরিনারি মেডিসিনের এই বিদেশী নাগরিকের মতো যোগ্যতাসম্পন্ন জনশক্তি বাংলাদেশে প্রতিবছর বের হয় অন্তত ছয় হাজার। কিন্তু তারা সবাই চাকরি পান না। যারা পান, তারা অনেক কম বেতনে চাকরি করেন।

ইসলাম গ্রুপের প্রতিষ্ঠান আফতাব ফিডে বহু বিদেশী চাকরি করেন বলে জানা গেছে, যাদের বেতন মাসে তিন লাখ থেকে পাঁচ লাখ টাকা। এদের একজন ফিলিপাইনের নাগরিক জন্ডিলা বাইয়ান। তিনি ফিলিপাইনের একটি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এনিম্যাল হাসব্যান্ড্রি থেকে মাস্টার্স করেছেন। তিনি আফতাব ফিডের চিফ নিউট্রিশনিস্টের দায়িত্বে রয়েছেন; প্রতি মাসে প্রায় পাঁচ লাখ টাকা বেতন পান। এ প্রতিষ্ঠানে বয় নামের আরেক ফিলিপিনো পুষ্টিবিদ কাজ করেন উঁচু বেতনে। অথচ এখানে যেসব দেশি কর্মী এনিম্যাল হাসব্যান্ড্রি থেকে মাস্টার্স করে পুষ্টিবিদ হিসেবে কর্মরত আছেন, তাদের বেতন গড়ে ৩০ হাজার থেকে ৪০ হাজার টাকার মধ্যে।

রাজস্ব ফাঁকি:

বিদেশীরা শুধু দেশের নাগরিকদের কর্মসংস্থানেই সঙ্কট সৃষ্টি করছেন না, একই সঙ্গে তাঁরা দেশের প্রচলিত আইন উপেক্ষা করে রাজস্বও ফাঁকি দিচ্ছেন। বর্তমান আইনে বিদেশীদের অর্জিত আয়ের ৩০ শতাংশ কর দেওয়ার নিয়ম রয়েছে। এ ছাড়া বাংলাদেশী কোনো প্রতিষ্ঠান অবৈধ কিংবা ওয়ার্ক পারমিট ছাড়া বিদেশীদের নিয়োগ দিলে ওই কোম্পানির প্রদেয় আয়করের সর্বোচ্চ ৫০ শতাংশ বা কমপক্ষে পাঁচ লাখ টাকা জরিমানার বিধান আছে। তবে এ জরিমানা কাউকে কখনো করা হয়েছে কি না তা কেউ জানাতে পারেনি। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই এ নিয়ম মানছেন না বিদেশীরা।