চক্রাকার বাসের সার্ভিসের সুফল নিয়ে সংশয়

নিউজ ডেস্ক:বিআরটিসি বাসরাজধানীতে বাস রুট রেশনালাইজেশনের অংশ হিসেবে চক্রাবার বাস সার্ভিস চালুর উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। প্রথম অবস্থায় ধানমন্ডি-নিউমার্কেট-আজিমপুর রুটে অত্যাধুনিক ২৫ থেকে ৩০টি এবং বিমানবন্দর থেকে প্রগতি সরণি হয়ে মতিঝিল ‍রুটে চারটি ডাবল ডেকার বিআরটিসি বাস চালুর উদ্যোগ নেওয়া হয়। আজ বুধবার, (২৭ মার্চ) প্রাথমিকভাবে এ দুটি বাস সার্ভিস উদ্বোধন করা হবে। এতে যানজট কম হওয়াসহ বেশ কিছু সুবিধার কথা বলা হলেও তা নিয়ে সংশয় প্রকাশ করেছেন পরিবহন বিশেষজ্ঞরা।
তারা বলছেন, বাস রুট ,অন্যান্য পরিবহন এবং যাত্রীদের বিষয়ে এখনও অনেক পরিকল্পনার প্রয়োজন রয়েছে। তাছাড়া এই দু’টি রুটে এখনও যানজট লেগে থাকে। এ অবস্থায় পরিসংখ্যান ছাড়া নতুন করে আরও বাস নামানো হলে যানজটের মাত্রা আরও বাড়বে। এর মাধ্যমে সড়কের যে ‘রোগ’ রয়েছে তা সমাধান হবে না। এজন্য আগে রিকশা, প্রাইভেটকার ও অন্যান্য গাড়ির ব্যবহার নিয়ন্ত্রণ বা নির্দেশনা প্রণয়ন করেই সড়কটিতে বাস নামানো উচিৎ। তা না হলে এর সুফল আসবে না।
জানতে চাইলে গণপরিবহন বিশেষজ্ঞ ও বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের অধ্যাপক ড. শামসুল হক বলেন, ‘নতুন করে রুট পারমিট দিয়ে আরও সমস্যার সৃষ্টি করা হবে। আসলে আমরা দেখতে পাচ্ছি বাসই তো যানজট সৃষ্টি করছে। এই বাস চালুর মাধ্যমে কোনও ফায়দা হবে কিনা কিংবা এটা কোন স্টাডিতে আছে তা আমার জানা নেই। কারণ এ সংক্রান্ত প্রতিটি স্টাডিতেই তো এগুলোর বিস্তারিত বলে দেওয়া হয়েছে।
তিনি বলেন, ‘এখানে কমিটিকে দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে করিডোর নির্ধারণ করে দেওয়ার জন্য। কিন্তু কমিটি যা করছে তাকে সমাধানের পথ বলা যাবে না। উনাদের (কমিটি) বলা হয়েছে বাস রুট ফ্রাঞ্চাই’র বিষয়ে। এর মানে একেকটা করিডোরে একেকটা কোম্পানি থাকবে। এর ফলে বাসের সংখ্যা অনেক কমবে। এখন বিআরটিসি বাসের কোনও দায়বদ্ধতা নেই। এদের দিয়ে চালু করতে পারে। কিন্তু সড়কে বর্তমানে যে ‘রোগ’ রয়েছে এর মাধ্যমে সেই রোগের চিকিৎসা হবে না।
রাজধানীর গণপরিবহনে শৃঙ্খলা ফেরানো ও যানজট নিরসনের লক্ষ্যে গত বছর ৯ সেপ্টেম্বর এই কমিটি গঠন করা হয়। ডিএসসিসির মেয়রকে আহ্বায়ক করে ১০ সদস্যের এই কমিটিতে ডিএনসিসির মেয়রকে যুগ্ম-আহ্বায়ক করা হয়েছে। কমিটির অন্য সদস্যরা হলেন—বিআরটিএ’র চেয়ারম্যান, বাংলাদেশ রোড ট্রান্সপোর্ট করপোরেশনের চেয়ারম্যান, রাজউকের চেয়ারম্যান, ডিএমপির কমিশনার, গণপরিবহন বিশেষজ্ঞ, বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন মালিক সমিতির মহাসচিব, বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন শ্রমিক ফেডারেশনের সভাপতি এবং ঢাকা পরিবহন সমন্বয় কর্তৃপক্ষের নির্বাহী পরিচালক। এরই মধ্যে কমিটি বেশ কয়েকটি বৈঠক শেষ করেছে। গত ২০ মার্চ এ সংক্রান্ত কমিটির এক সভায়, ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশ কমিশনার আছাদুজ্জামান মিয়া একটি প্রস্তাবনা উত্থাপন করেন।
কমিটির প্রধান মেয়র সাঈদ খোকন ওই প্রস্তাবনার সঙ্গে একমত পোষণ করে দাবি করেন, ধানমন্ডি-সায়েন্সল্যাব-নিউমার্কেট-আজিমপুর রুটে চক্রাকার বাস চালু করলে গুলশান ও হাতিরঝিল এলাকার মতো এই সড়কটিতেও যানজট কমবে। অধিক আরামদায়ক পরিবহন পেলে সাধারণ যানবাহনের চাহিদা কমে যাবে। এলাকার শপিং, হাসপাতাল ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে আসা প্রাইভেট গাড়ি কমবে। মানুষ স্বল্পমূল্যে বেশি সুবিধাজনক এসি বাসে চলাচল করতে পারবে। টিকিট সিস্টেমের মাধ্যমে এই বাসগুলো চালু করা হলে সড়কে চালকদের প্রতিযোগিতা থাকবে না। ফলে দুর্ঘটনা রোধ হবে।
ওই সভা শেষে সাঈদ খোকন ঘোষণা দেন- ‘ধানমন্ডি-সায়েন্সলাব-আজিমপুর রুটে চক্রাকার বাস সার্ভিস চালু হবে। এতে বিআরটিসি’র যে ৪০০টি অত্যাধুনিক বাস আনা হচ্ছে তা থেকে ২০ থেকে ২৫টি বাস এই রুটে দেওয়া হবে। এজন্য ৩৬টি স্পট করে দেওয়া হবে। এসব স্পটে বাসগুলো এসে নির্ধারিত সময়ের জন্য অপেক্ষা করবে। এসব কাউন্টারে প্রতি পাঁচ মিনিট অন্তর অন্তর একটি করে বাস আসবে। যাত্রী তোলা শেষে কাউন্টার ত্যাগ করবে।’
অপরদিকে কমিটির যুগ্ম আহ্বায়ক ও ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের মেয়র মো. আতিকুল ইসলাম আজ বুধবার (২৭ মার্চ) পৃথকভাবে উত্তরা থেকে প্রগতি সরণি হয়ে মতিঝিল পর্যন্ত বিআরটিসির চারটি ডাবল ডেকার চক্রাকার বাস সার্ভিস উদ্বোধন করবেন। তবে এটি বাস রুট রেশনালাইজেশন সংশ্লিষ্ট কোনও উদ্যোগ নয় বলে জানিয়েছেন তার একান্ত সচিবের দায়িত্বে থাকা ডিএনসিসির নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট সাজিদ আনোয়ার। দুটি কাজের সঙ্গে সমন্বয় না থাকায় কমিটির কাজের ব্যাঘাত ঘটবে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে। এটি মেয়র আতিকুল ইসলাম ও বিআরটিসির নিজস্ব ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে বাস্তবায়ন হচ্ছে।
জানতে চাইলে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের নগর ও অঞ্চল পরিকল্পনা বিভাগের অধ্যাপক ও বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব প্ল্যানার্সের (বিআইপি) সহ-সভাপতি আকতার মাহমুদ বলেন, ‘গুলশান, বনানী ও বারিধারায় এই কাজটি হয়ে গেছে। সেখানে আমরা সফল হয়েছি। এখন কাজ হবে সেটাকে শহরব্যাপী বাস্তবায়ন করা।
তিনি বলেন, ‘ধানমন্ডি,নিউমার্কেট ও আজিমপুর এলাকায় পরীক্ষামূলক যে কাজ হাতে নেওয়া হয়েছে সেটার জন্য ভালোভাবে একটা জরিপ করা দরকার ছিল। নতুন বাস নামানোর কারণে সড়কে পরিবহনের সংখ্যা বাড়লেও কিছু রিকশা ও প্রাইভেটকার ব্যবহারকারীদের এই পরিবহনে টানা যাবে। এর ফলে কিছুটা পরিবর্তন আসবে। কমিটির উচিৎ হবে রিভাইস স্ট্র্যাটেজিক ট্রান্সপোর্ট প্ল্যানে (আরএসটিপি) যে সুপারিশ দেওয়া আছে সেগুলো পুঙ্খানুপুঙ্খরূপে অনুসরণ করা। পরিবহন সংশ্লিষ্ট সকল কাজে সমন্বয় রাখতে হবে।’
গণপরিবহন বিশেষজ্ঞরা বলছেন, রাজধানীতে যানজটের অন্যতম একটি কারণ হচ্ছে, মাত্রাতিরিক্ত ব্যক্তিগত গাড়ি ও রিকশা। এছাড়া রাস্তার স্বল্পতা, সমন্বয়হীন রুট পারমিট, মেয়াদোত্তীর্ণ গাড়ি চলাচল, অপ্রশস্ত সড়ক, বেপরোয়া বাস-মিনিবাস, যত্রতত্র ট্রাকস্ট্যান্ড, রেলগেট, মিনিবাস ও মাত্রাতিরিক্ত হিউম্যান হলার যানজটকে স্থায়ী রূপ দিয়েছে। এ অবস্থায় এসব সমস্যা সমাধান না করে বিদ্যমান সড়কে নতুন করে পরিবহন নামানো হলে যানজট আরও বাড়বে।
এ বিষয়ে ড. শামসুল হক বলেন, দুর্ঘটনার কারণ যেটা- সেটা থেকেই যাচ্ছে। উনাদের (কমিটির সদস্যদের) মেয়র আনিসুল হকের অসমাপ্ত কাজ সমাপ্ত করতে বলা হয়েছে। আনিসুল হকের পরিকল্পনা ছিল একেকটা করিডোরে একেকটা বাস চালু করা। আসলে কমিটি সেই দায়িত্ব নিচ্ছে না। এর দায়দায়িত্ব কে নেবে? এই পরিবহন বিশেষজ্ঞ আরও বলেন, কমিটি গঠনের প্রজ্ঞাপনে বলা হয়েছে, সড়কে শৃঙ্খলা ফেরানোর জন্য কোম্পানিভিত্তিক বাস সার্ভিস চালু করা। কিন্তু সেটাকে আমলে নেওয়া হচ্ছে না।
বিষয়টি নিয়ে জানতে চাইলে মেয়র সাঈদ খোকন বলেন, ‘নতুন বাস নামানোর ফলে যেসব পুরানো বাস থাকবে সেগুলো কীভাবে উঠিয়ে নেওয়া যায় আমরা সেটা আলাপ-আলোচনার মধ্য দিয়ে সমাধান করবো। এই কাজটির মাধ্যমে আমরা আমাদের যে উদ্যোগ সেটার সূচনা করলাম। পর্যায়ক্রমে আরও কোম্পানি ও রুট নির্ধারণ করে রাজধানীর সড়কে আধুনিক বাস নামানো হবে।