কী হবে ইয়াবা ব্যবসায়ীদের আত্মসমর্পণে আইনি প্রক্রিয়া ?

নিজস্ব প্রতিবেদক:
ইয়াবাকক্সবাজারের ইয়াবা ব্যবসায়ীদের আত্মসমর্পণ করানোর প্রক্রিয়া শুরু করেছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। ইতোমধ্যে ৭৫ জন ইয়াবা ব্যবসায়ী পুলিশের কাছে আত্মসমর্পণ করার জন্য তালিকায় নাম লিখিয়েছে। স্থানীয় পুলিশ কর্মকর্তারা বলছেন, এই সংখ্যা প্রতিদিনই একজন-দুজন করে বাড়ছে। ফেব্রুয়ারি মাসের মাঝামাঝি সময়ে আত্মসমর্পণের তারিখ নির্দিষ্ট হওয়া পর্যন্ত শতকের ঘর পেরিয়ে যাবে বলে তারা মনে করেন। কিন্তু ইয়াবা ব্যবসায়ীদের আত্মসমর্পণ করানোর আইনি প্রক্রিয়া কী হবে?

পুলিশ কর্মকর্তারা জানান,এ বিষয়ে এখনও চূড়ান্ত কোনও সিদ্ধান্ত হয়নি। আগামী ৪ ফেব্রুয়ারি থেকে পুলিশ সপ্তাহ শুরু হচ্ছে। পুলিশ সপ্তাহ শেষ হলে বিষয়টি চূড়ান্ত করা হবে। তবে যারা আত্মসমর্পণ করবে, তাদের যে এমনিতেই দায়মুক্তি দেওয়া হবেবিষয়টি তেমন নয়। প্রত্যেককেই আইনি প্রক্রিয়া মোকাবিলা করতে হবে। এক্ষেত্রে রাষ্ট্রীয়ভাবে তাদের জন্য অনুকম্পা দেওয়া হতে পারে।

ইয়াব ব্যবসায়ীদের আত্মসমর্পণের উদ্যোগ যিনি নিয়েছেন, কক্সবাজারের সেই পুলিশ সুপার এবিএম মাসুদ হোসেন বলেন, ‘ইয়াবা ব্যবসায়ী যারা আত্মসমর্পণের জন্য আমাদের সঙ্গে যোগাযোগ করছে, আমরা তাদের তালিকা করছি। প্রক্রিয়া নিয়ে ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের সঙ্গে আলোচনা হচ্ছে। আমরা আইনি প্রক্রিয়ার মাধ্যমেই তাদের আত্মসমর্পণ করাবো। আত্মসমর্পণ করলেও সবাইকে আইনি প্রক্রিয়া মোকাবিলা করতে হবে।’

গত বছরের মে মাস থেকে দেশজুড়ে মাদকবিরোধী সাঁড়াশি অভিযান শুরু করে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর একাধিক সংস্থা। এসব অভিযানে এপর্যন্ত চার শতাধিক ব্যক্তি ‘বন্দুকযুদ্ধে’ নিহত হয়েছে, যাদেরকে মাদক ব্যবসায়ী বলে অভিহিত করেছেন আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা। এর মধ্যে কক্সবাজারেই নিহত হয়েছেন প্রায় অধর্শত ব্যক্তি।

পুলিশ কর্মকর্তারা বলছেন, বর্তমানে দেশে সবচেয়ে বেশি যে মাদকপণ্যের বিস্তৃতি, তা হলো ইয়াবা। পাশের দেশ মিয়ানমার থেকে ইয়াবা আনা হয়। দেশের ভেতরে ইয়াবা আসার সবচেয়ে বড় রুট হলো কক্সবাজারের টেকনাফ উপজেলা। এখানকার নাফ নদীর প্রায় ৬০ কিলোমিটার সীমান্ত দিয়ে সবচেয়ে বেশি ইয়াবা দেশে প্রবেশ করে। কক্সবাজার ও টেকনাফের স্থানীয় ব্যক্তিদের অনেকেই এই ব্যবসার সঙ্গে জড়িত। এজন্য স্থানীয় মাদক ব্যবসায়ীদেরকে আত্মসমর্পণের মাধ্যমে আইনের আওতায় আনা হলে ইয়াবা প্রবেশ কিছুটা নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব হবে।

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, ইয়াবা ব্যবসায়ীদের আত্মসমর্পণের পর তাদের ছেড়ে দেওয়া হবে কিনা— এই প্রক্রিয়া নিয়ে আলোচনা চলছে। যারা নিজেদের আত্মস্বীকৃত ইয়াবা ব্যবসায়ী হিসেবে ঘোষণা দিয়ে আত্মসমর্পণ করবে, রাষ্ট্রীয়ভাবে তাদের কিছু অনুকম্পা দেওয়া হবে। কিন্তু আইনি প্রক্রিয়া তাদের মোকাবিলা করতেই হবে। সংশ্লিষ্ট পুলিশ কর্মকর্তারা বলছেন, এখানে আইনগত কিছু সীমাবদ্ধতাও আছে। আগে যেমন দণ্ড দেওয়ার ক্ষেত্রে মাদকের কোনও লিমিট ছিল না। এখন পাঁচ গ্রামের বেশি ইয়াবা উদ্ধার করা হলে— সংশ্লিষ্ট ব্যক্তির ফাঁসির দণ্ড হতে পারে। এই বিষয়টি মাথায় রেখে প্রক্রিয়া চূড়ান্ত করা হচ্ছে। কারণ, যারা আত্মসমর্পণ করবে, তাদের সংশোধনের সুযোগ না দিয়ে ফাঁসির মামলায় ঠেলে দেওয়াটা সমীচীন হবে না।

পুলিশের একজন দায়িত্বশীল কর্মকর্তা জানিয়েছেন, যারা আত্মসমর্পণ করতে চাইছেন, তাদের প্রত্যেকের বিরুদ্ধে আগে থেকে একাধিক মামলা রয়েছে। সেসব মামলা তাদের মোকাবিলা করতে হবে। একই সঙ্গে তাদের পূর্ণাঙ্গ বায়োডাটা ও সম্পত্তির হিসাবের তালিকা তৈরি করা হবে। এসব সম্পত্তি বৈধ আয়ের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ কিনা, তা খতিয়ে দেখতে দুর্নীতি দমন কমিশন- দুদকের কাছে পাঠানো হবে। তারা সেসব বিষয় তদন্ত করে আইনগত ব্যবস্থা নেবে। ফলে আত্মসমর্পণ মানেই যে দায়মুক্তি বা অবৈধভাবে উপার্জিত অর্থে বিলাসবহুল জীবন-যাপন করতে পারবে তা নয়।

পুলিশ সদর দফতর সূত্র জানায়, বন্দুকযুদ্ধে যেসব ইয়াবা ব্যবসায়ী নিহত হয়, তাদের অর্থসম্পদ সাধারণত তাদের উত্তরসূরীরা ভোগ করে থাকেন। যারা আত্মসমর্পণ করবে তাদের অবৈধ অর্থ-সম্পদের একটি বড় অংশ জব্দ করে রাষ্ট্রীয় কোষাগারে জমা দেওয়া যায় কিনা, তা নিয়েও আলোচনা চলছে। কারণ, বিশ্বের বিভিন্ন দেশে অপরাধ কর্মকাণ্ডের জন্য অপরাধীদের সম্পত্তি জব্দ করার নজির রয়েছে।

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর মাদকবিরোধী কঠোর অভিযানে ‘বন্দুকযুদ্ধে’ নিহত হওয়ার চেয়ে ইয়াবা ব্যবসায়ীরা আত্মসমর্পণের মাধ্যমে বেঁচে থাকতে চাইছে। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীও তাদের ভালো পথে ফিরে আসার সুযোগ করে দিচ্ছে। আত্মসমর্পণের আইনি প্রক্রিয়া মোকাবিলার পাশাপাশি সমাজে ভালো ভূমিকা, মাদক প্রতিরোধে কার্যকর ভূমিকা রাখার আহ্বান জানানো হবে। তালিকাভুক্ত এসব ইয়াবা ব্যবসায়ীর বিরুদ্ধে নিয়মিত নজরদারির মাধ্যমে তাদের রাষ্ট্রীয় অনুকম্পার পরিমাপ নির্ধারণ করা হতে পারে।