এনটিটিএন লাইসেন্স নিয়ে শুরু হয়েছে বিতর্ক

ইন্টারনেট ব্যবহারকারীর সংখ্যা ৯ কোটি

নিউজ ডেস্ক: ইন্টারনেটের দাম কমাতে আরও এনটিটিএন (ন্যাশনওয়াইড টেলিকমিউনিকেশন ট্রান্সমিশন নেটওয়ার্ক বা ভূগর্ভস্থ ক্যাবল সেবা) লাইসেন্স প্রয়োজন আছে কী নেই, এ নিয়ে শুরু হয়েছে বিতর্ক। ইন্টারনেট সেবাদাতা প্রতিষ্ঠানগুলো বলছে, ইন্টারনেটের চার্জ কমাতে অন্তত আরও দুটি এনটিটিএন লাইসেন্স প্রয়োজন। অন্যদিকে, এনটিটিএন প্রতিষ্ঠানগুলো বলছে, লাইসেন্স দেওয়া হোক, তাতে কোনও সমস্যা নেই। কিন্তু এমন সংখ্যায় যেন দেওয়া না হয় যা বাজার নষ্ট করে।

এনটিটিএনগুলোর বিরুদ্ধে দীর্ঘদিনের অভিযোগ, সক্রিয় মাত্র দুটি এনটিটিএন প্রতিষ্ঠান ইন্টারনেট ব্যান্ডউইথ পরিবহনে একচেটিয়া বাজার দখল করে আছে। ইন্টারনেট সেবাদাতা প্রতিষ্ঠানগুলোকে এই দুটি অপারেটর থেকেই সেবা নিতে হয়। বিকল্প না থাকায় প্রতিষ্ঠান দুটি ইচ্ছেমতো ট্রান্সমিশন চার্জ নিচ্ছে। সরকার ট্রান্সমিশন চার্জ বেঁধে না দেওয়ায় তারা নিজেরাই ব্যান্ডউইথ পরিবহন চার্জ আরোপ করছে। অন্যদিকে, এনটিটিএন অপারেটরগুলোর দাবি, তাদের চার্জ যৌক্তিক।

সংশ্লিষ্টরা বলছেন,এনটিটিএনের সংখ্যা কম হওয়া এবং ব্যান্ডউইথ পরিবহনে (ট্রান্সমিশন) ইচ্ছেমতো চার্জ আরোপ করায় ইন্টারনেটের দাম কমছে না বলে অভিযোগ করেছেন ইন্টারনেট সেবাদানের সঙ্গে সংশ্লিষ্টরা। এনটিটিটিএনের সংখ্যা বাড়ানো গেলে এ খাতে প্রতিযোগিতা তৈরি হবে। অন্যদিকে ব্যান্ডউইথ পরিবহন চার্জও কমবে। ফলে ইন্টারনেট সেবাদাতা প্রতিষ্ঠানগুলো আরও কম দামে ইন্টারনেট সেবা দিতে পারবে গ্রাহককে।

এ বিষয়ে ডাক, টেলিযোগাযোগ ও তথ্যপ্রযুক্তিমন্ত্রী মোস্তাফা জব্বার বাংলা ট্রিবিউনকে বলেছিলেন,‘আরও এনটিটিএন লাইসেন্স দেওয়ার প্রয়োজন রয়েছে কিনা তা এ সরকার দেখবে। ইন্টারনেটের দাম কমার ক্ষেত্রে যদি বেশি এনটিটিএন লাইসেন্স দেওয়ার কোনও যৌক্তিকতা থাকে, তাহলে দেওয়া হবে।’

মন্ত্রী জানান, আইটিইউয়ের (ইন্টারন্যাশনাল টেলিকমিউনিকেশন ইউনিয়ন) কাছ থেকে ইন্টারনেটের দামের ওপর একটা কস্ট মডেলিং পাওয়া গেছে। বিটিআরসি একটা কস্ট মডেলিং দাঁড় করাচ্ছে।

দেশে পাঁচটি এনটিটিএন থাকলেও দুটি প্রাইভেট এনটিটিএনের কাজই কেবল দৃশ্যমান। বাংলাদেশ রেলওয়ে, বাংলাদেশ টেলিযোগাযোগ কোম্পানি লিমিটেড (বিটিসিএল) এবং পাওয়ার গ্রিড কোম্পানি অব বাংলাদেশ এনটিটিএনের লাইসেন্স নিলেও তারা এই সেবার ক্ষেত্রে নিষ্ক্রিয় অবস্থায় রয়েছে। অন্যদিকে, ফাইবার অ্যাট হোম ও সামিট কমিউনিকেশন লিমিটেড অপারেটর দুটি সারা দেশে ব্যান্ডউইথ পরিবহনের কাজ করছে। অপারেটর দুটির সক্ষমতা, অবকাঠামো নির্মাণে অপ্রতুলতা এবং কাভারেজ এরিয়া সারা দেশে না হলেও ব্যান্ডউইথ পরিবহনে এই দুটি অপারেটরের ওপর নির্ভর করতে হয় ইন্টারনেট সেবাদাতা প্রতিষ্ঠানগুলোকে (আইএসপি)। অন্যদিকে সংশ্লিষ্টরা বলছেন, অন্তত নতুন দুটি এনটিটিএন লাইসেন্স দেওয়া হলেও ব্যান্ডউইথ পরিবহন খরচ কম হবে।

প্রসঙ্গত, বিটিআরসি ২০১৩ ও ২০১৪ সালের দুটি নির্দেশনা স্থগিত করে দেশে ট্রান্সমিশন নেটওয়ার্ক সেবা পুরোপুরি এনটিটিএন অপারেটরগুলোকে দিয়েছে। ইন্টারনেট সেবাদাতা প্রতিষ্ঠানগুলোর মতে, ব্যান্ডউইথ সংগ্রহ থেকে গ্রাহকের কাছে পৌঁছতে ১৬টি উপাদান বা মাধ্যম ব্যবহার হয়। এগুলোর মধ্যে ব্যান্ডউইথ একটি উপাদান। শুধু ব্যান্ডউইথের দাম কমিয়ে ইন্টারনেটের দাম কমানো সম্ভব হবে না। ১৬টি উপাদান বা স্টেপের মাধ্যমে গ্রাহকের কাছে ইন্টারনেট পৌঁছতে যে পরিমাণ অর্থ আইএসপিগুলোর খরচ হয় তার মধ্যে ব্যান্ডউইথ কিনতে ব্যয় হয় মাত্র ছয় থেকে আট ভাগ অর্থ। সবচেয়ে বেশি (৫০ ভাগের বেশি) অর্থ ব্যয় হয় ব্যান্ডউইথের ট্রান্সমিশনে। তাই কেবল ব্যান্ডউইথ নয়, সবগুলো মাধ্যম ব্যবহারের খরচ আনুপাতিকহারে কমালেই কেবল ইন্টারনেটের দাম কমানো সম্ভব হবে।

জানতে চাইলে সামিট কমিউনিকেশন্স লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও প্রধান নির্বাহী আরিফ আল ইসলাম বলেন, ‘আমরা ট্রান্সমিশন চার্জ মোটেও বেশি নিচ্ছি না। একটি যৌক্তিক হারেই নেওয়া হচ্ছে। আইএসপি অপারেটররা যদি ব্যান্ডউইথের ভলিউম বেশি নেন তাহলে খরচ কম পড়বে। আর যারা অল্প পরিমাণে নেন তাদের হয়তো চার্জ গড়ে বেশি হয়ে যায়।’ তিনি মনে করেন, ঢাকার বাইরের আইএসপিগুলো যদি বেশি ভলিউমে ব্যান্ডউইথ নেয় তাহলে তাদের চার্জ অনেক কম পড়বে। তিনি উল্লেখ করেন, কেউ যদি ১০ এমবিপিএস ব্যান্ডউইথ নেন তাহলে তিনি কীভাবে চলবেন। ১০০ এমবিপিএস হলে সব দিক দিয়ে খরচ কম পড়বে।

ট্রান্সমিশন পরিবহনের দাম বেঁধে দেওয়ার বিষয়ে আরিফ আল ইসলাম বলেন,‘দাম বেঁধে দেওয়া হলে আমরা অনেক খুশি হবো। দুই বছর ধরে আমরা সরকারের কাছে এটা চাইছি।’ তিনি উল্লেখ করেন, নিশ্চয়ই অন্যান্য দেশের সঙ্গে মিল রেখেই এটি করা হবে। তিনি ভারতের উদাহরণ দিয়ে বলেন,‘আমাদের দেশে ব্যান্ডউইথ ট্রান্সমিশন চার্জ ভারতের চেয়ে কোথাও ৫০, কোথাও ৩০ ভাগেরও কম।’

এ প্রসঙ্গে তিনি জানান, এনটিটিএনগুলোর কোয়ালিটি অব সার্ভিস প্রায় ৯৯.৯ শতাংশ। ৯০ শতাংশ লিংক সব সময় সচল থাকে। অবশিষ্ট ১০ শতাংশ লিংক বিভিন্ন সময় যে উন্নয়নমূলক কাজ চলার কারণে কাটা যায়। সে কারণে মাঝে মাঝে লিংক ডাউন হয় এবং যত দ্রুত সম্ভব লিংক সচল করার চেষ্টা করা হয়। তিনি আরও জানান, এনটিটিএনগুলো এরই মধ্যে দেশে ৯০ হাজার কিলোমিটার নেটওয়ার্ক তৈরি করেছে।

জানা যায়, দেশের ২৩টি শীর্ষ ইন্টারনেট সেবাদাতা প্রতিষ্ঠানের সমন্বয়ে একটি নতুন কোম্পানি গঠন করে এনটিটিএন লাইসেন্সের আবেদন করা হয়েছে। টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রক সংস্থা বিটিআরসির চেয়ারম্যান বরাবর গত বছরের ২ অক্টোবর এই চিঠি পাঠানো হয়। দেশের ২৩টি শীর্ষ ইন্টারনেট সেবাদাতা প্রতিষ্ঠানকে নিয়ে ‘সংযোগ নেটওয়ার্ক লিমিটেড’ নামে নতুন একটি কোম্পানি গঠন করা হয়েছে। এই কোম্পানি নতুন একটি এনটিটিএন লাইসেন্স চায়। কোম্পানিটি লাইসেন্স পেলে ঢাকাসহ ঢাকার বাইরে ক্যাবল টেনে ব্যান্ডউইথ পরিবহন করবে। এছাড়া অন্যান্য প্রতিষ্ঠানের কাছেও ভাড়া দিতে পারবে। ফলে কম দামে ব্যান্ডউইথ পরিবহনের পাশাপাশি একেবারে তৃণমূল পর্যায়ে কম দামে ইন্টারনেট পৌঁছানো যাবে এবং ‘এক দেশ এক রেট’ ইন্টারনেট সেবা দেওয়া যাবে বলে মনে করছেন এর উদ্যোক্তারা।

জানতে চাইলে দেশের ইন্টারনেট সেবাদাতা প্রতিষ্ঠানগুলোর সংগঠন আইএসপিএবির সাধারণ সম্পাদক ইমদাদুল হক অভিযোগ করে বলেন, ‘আমাদের হাতে বিকল্প অপশন নেই বলে এনটিটিএনগুলো মনোপলি করছে। নতুন লাইসেন্স দেওয়া হলে এটা ভেঙে যাবে।’ তিনি আরও অভিযোগ করেন, ‘এনটিটিএনগুলোর কোয়ালিটি অব সার্ভিস খুবই খারাপ। কোনও লিংক কাটা গেলে তিন দিনের আগে ঠিক হয় না, ন্যূনতম ২৪ ঘণ্টা লাগে। এই সময়ে আমরা কীভাবে গ্রাহককে সেবা দেবো’– প্রশ্ন করেন তিনি। তিনি বলেন, ‘আরও লাইসেন্স দেওয়া হলে একটা সুস্থ প্রতিযোগিতা হবে। আমরা ভালো সেবা পাবো।’ বেশি লাইসেন্স এলে বাজার নষ্ট হতে পারে উল্লেখ করলে ইমদাদুল হক বলেন, ‘বেশি লাইসেন্স এলে বাজার নষ্ট হয় না। যদি তাই হতো তাহলে আমরা এক হাজার আইএসপি টিকে আছি কীভাবে।’ তিনি আরও বলেন, ‘এনটিটিএন প্রতিষ্ঠান দুটি পাঁচ শতাংশ নেটওয়ার্কও নিজেরা তৈরি করেনি। এগুলো বাংলাদেশ রেলওয়ে, পিজিসিবি আর মোবাইল ফোন অপারেটরগুলোর তৈরি নেটওয়ার্ক।’ তিনি মনে করেন, ট্রান্সমিশন চার্জ সরকার বেঁধে দিলে ইন্টারনেটের দামও বেঁধে দিতে হবে। তা না হলে ইন্টারনেটের দাম কমবে না।

ইমদাদুল হক বলেন, ‘ন্যাশন ওয়াইড আইএসপিগুলোতে পর্যাপ্ত কারিগরি জ্ঞানসম্পন্ন জনবল রয়েছে। লাইসেন্স ইস্যু হওয়ার পরে স্বল্প সময়ে দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলে নেটওয়ার্ক সম্প্রসারণ করা সম্ভব হবে।’ তার অভিযোগ, বর্তমান পরিস্থিতিতে বিদ্যমান এনটিটিএন কোম্পানিগুলোর অনাগ্রহ ও উচ্চমূল্যের কারণে কাঙ্ক্ষিত সেবার সম্প্রসারণ হচ্ছে না।