এই উড়ালসড়ক লইয়া আমরা কী করিব!

এ কে এম জাকারিয়া : মগবাজার-মৌচাক উড়ালসড়ক নিয়ে শেষ পর্যন্ত হায় হায় করা ছাড়া আমাদের আর কোনো পথ আছে বলে মনে হচ্ছে না। ২০১১ সালে যে উড়ালসড়ক বানানোর খরচ ধরা হয়েছিল ৭৭৩ কোটি টাকা, তা শেষ পর্যন্ত হাজার কোটি টাকা ছাড়িয়ে যেতে পারে। সব মিলিয়ে তিন অংশের কাজ শেষ হওয়ার কথা ছিল ২০১৬ সালের ডিসেম্বর মাসে। সেটাও হয়নি। অনেক আশা নিয়ে মগবাজার-মৌচাক এলাকার আশপাশের লোকজন এবং ওই এলাকা দিয়ে যাতায়াত করেন, এমন লোকজন মুখ বুজে দুর্ভোগ সহ্য করে যাচ্ছেন। এই প্রকল্পের শেষ পর্যায়ে এসে এখন আমরা নাগরিকেরা জানতে পারছি যে এই উড়ালসড়কের মৌচাক পয়েন্টে ট্রাফিক সিগন্যাল থাকবে!

কোনো প্রকল্প এমনি হাতে নেওয়া হয় না। এর পেছনে একটি মূল উদ্দেশ্য থাকে; যে মূল উদ্দেশ্যকে বিবেচনায় নিয়ে এই উড়ালসড়ক বানানোর প্রকল্প অনুমোদিত হয়েছে, তা হচ্ছে মালিবাগ-মৌচাক এলাকার যানজট দূর করা। যে নকশা অনুযায়ী এখন উড়ালসড়ক তৈরি হচ্ছে, তাতে দেখা যাচ্ছে উড়ালসড়কের মৌচাক পয়েন্টে সিগন্যাল-ব্যবস্থা ছাড়া কোনো উপায় নেই। এই পয়েন্টে যানজট দূর হবে, এমন আশার গুড়ে সত্যিই বালির স্তর পড়ে গেছে। এত অর্থ খরচ করে তবে এই উড়ালসড়ক বানানো হলো কিসের জন্য? আর এমন একটি ত্রুটিপূর্ণ নকশা অনুমোদিত হলো কীভাবে?

শেষ পর্যায়ে এসে এখন বলা হচ্ছে, মৌচাক পয়েন্টে সিগন্যাল ছাড়া কোনো পথ নেই। এটা এড়াতে হলে এখন উড়ালসড়ককে তিনতলা-চারতলা করার নানা গল্প শোনানো হচ্ছে। বলা হচ্ছে, এমন কিছু করতে হলে এখন চারপাশে অনেক জায়গা লাগবে। বহুতল বাড়িঘর ভাঙতে হবে, জায়গা অধিগ্রহণ করতে হবে। বাস্তবে তা করা আদৌ সম্ভব হবে না। প্রশ্ন হচ্ছে, এত দিন পর এ নিয়ে জটিলতা কেন? প্রকল্পের নকশা পর্যায়ে কেন এর সমাধান ও সুরাহা করার চেষ্টা করা হয়নি? বোঝা যায়, কতটা আনাড়ি হাতে ও যোগ্যতাহীন লোকজনের হাত দিয়ে এই নকশা অনুমোদিত হয়েছে। মৌচাক ও মালিবাগের যানজট দূর হোক বা না হোক, হাজার কোটি টাকা খরচের ব্যবস্থা তো এরই মধ্যে হয়ে গেছে।

নগর যোগাযোগ পরিকল্পনা বিশেষজ্ঞ ও বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক অধ্যাপক সামছুল হককে ফোন করেছিলাম এ সমস্যার মূল দিকটি খুঁজে বের করতে। তিনি বললেন, নগরীতে কোনো কাঠামো নির্মাণের বিষয়টি খুবই জটিল। এখানে বহু বিষয় বিবেচনায় নিয়ে একটি প্রকল্প হাতে নিতে হয়। এ জন্য বিশেষায়িত জ্ঞানের দরকার হয়। এ ক্ষেত্রে নকশা অনুমোদনের সময়েই বড় ভুল হয়ে গেছে। যে মার্কিন কোম্পানি এই নকশা করেছে, তারা বাংলাদেশের বাস্তবতাকে বিবেচনায় নেয়নি। আর যারা এটি অনুমোদন করেছেন, তাদের নকশা বিচার-বিশ্লেষণের বিশেষজ্ঞ জ্ঞান নেই। এখন এই প্রকল্প বাস্তবায়ন করছে যারা, একটি নকশা অনুয়ায়ী তা করে ফেলার ক্ষমতা তাদের রয়েছে, কিন্তু সমস্যাটি তো নকশায়।

জানতে চেয়েছি, এটাকে আর সংশোধন করার পথ আছে কি? বর্তমান অবস্থায় এটাকে আর সংশোধনযোগ্য বলে তিনি মনে করেন না। এ ধরনের বড় স্থাপনা একবার ভুল নকশার ওপর ভিত্তি করে হয়ে গেলে সেখান থেকে ফিরে আসার পথ থাকে না। তিনি পরিষ্কার করেই বললেন, যে উদ্দেশ্য নিয়ে এই উড়ালসড়ক তৈরি করা হয়েছে, মৌচাকে সিগন্যালের কারণে তা পূরণ হবে না। সেখানে জট বাঁধবে, দুর্ঘটনার ভয়ও থাকবে। ফ্লাইওভারের ওপর যে সিগন্যাল থাকবে, সেটা যদি স্বয়ংক্রিয়ভাবে চলে, তবে আমাদের দেশের যে বাস্তবতা, তাতে তা না মানার সম্ভাবনাই বেশি। সে ক্ষেত্রে সিগন্যাল মানার বিষয়টি বাধ্য করার জন্য পুলিশ থাকতে হবে। সেই পুলিশ দাঁড়াবে কোথায়? এই ফ্লাইওভার যে ধরনের নকশায় করা হয়েছে, তাতে কোনো ওয়াক ওয়েও নেই। পুলিশ কোথায় দাঁড়িয়ে তার দায়িত্ব পালন করবেন?

ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের ট্রাফিক বিভাগের দায়িত্বশীল কর্মকর্তারা বলেছেন, বিশ্বের কোনো দেশে উড়ালসড়কের ওপর ট্রাফিক সিগন্যাল আছে বলে তাঁরা শোনেননি। এই উড়ালসড়কের সিগন্যাল-ব্যবস্থা কীভাবে এবং কে নিয়ন্ত্রণ করবে কে জানে। তবে সাধারণ জ্ঞান ও বিজ্ঞান বিবেচনায় নিলে এটা মানতেই হবে যে সিগন্যালের জন্য সেখানে জট লাগবে। আর সেখানে সার্বক্ষণিক পুলিশ না থাকলে দুর্ঘটনা ঘটার আশঙ্কাই বেশি।

এই উড়ালসড়ক লইয়া এখন আমরা কী করিব! এই যে এতগুলো অর্থ খরচ হলো, অথচ যথাযথ ফল মিলবে না—এর দায় কে নেবে? আমরা কার কাছে জবাবদিহি চাইব? – প্রথম আলো