আক্রমণের দিকে ফিরেছে আফগান যুদ্ধ

আন্তার্জাতিক ডেস্ক: সমঝোতা যখন একটা সেনা প্রত্যাহার চুক্তির দিকে এগুচ্ছিল বলে জানা গেলো, আফগান যুদ্ধ তখন একটা অপ্রত্যাশিত মোড় নিয়েছে এবং সরকারি সেনা ও তালেবানদের মধ্যে যুদ্ধের তীব্রতা বেড়ে গেছে। ‘সন্ত্রাসীদের’ বিরুদ্ধে আফগান সরকার ‘অপারেশান খালিদ’ ঘোষণা করার পর আফগান তালেবানরাও দেশের নিয়ন্ত্রণাধীন এলাকার ব্যাপ্তি বাড়াতে তাদের বার্ষিক ‘বসন্তকালীন অভিযানের’ ঘোষণা দেয়। গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো, এমন সময় এটা ঘটলো যখন তালেবানরা কাতারে যুক্তরাষ্ট্রের সাথে অনুষ্ঠিতব্য পরবর্তী বৈঠকে আফগান সরকারের প্রতিনিধিদের সাথে বসতে রাজি হয়েছিলো। এই মুহূর্তে অন্তত আফগান শান্তি আলোচনা একটা পুশব্যাক পরিস্থিতির মধ্যে চলে গেছে, যেখানে ভবিষ্যৎ নিয়ে মারাত্মক পরিণতির আশঙ্কা তৈরি হয়েছে।

আলোচনায় যুক্তরাষ্ট্রের প্রধান মধ্যস্থতাকারী জামলাই খলিলজাদ টুইটারে তালেবানদের অভিযানের ঘোষণা নিয়ে ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন।

“হতাহতের মাত্রা কমানোর তাৎক্ষণিক একটা উপায় হলো অস্ত্রবিরতিতে সম্মত হওয়া। তালেবানদের সিনিয়র নেতাদের উচিত তাদের প্রতিনিধিদের আলোচনার টেবিলে এসে আলোচনায় বসতে দেয়া। আমি এটা এগিয়ে নেয়ার চেষ্টা অব্যাহত রাখবো”। এ ধরনের ধারাবাহিক কিছু টুইট করেছেন খলিলজাদ গত সপ্তাহে, যেগুলো থেকে বোঝা গেছে কিভাবে আলোচনা এরই মধ্যে দিক হারিয়েছে এবং তার উপর মাঠের যুদ্ধের প্রভাব পড়েছে।

‘বসন্তকালীন অভিযানের’ উপর সরাসরি আঘাত করে তিনি আরও লিখেছেন, “তালেবানদের বসন্তকালীন অভিযানের ঘোষণা দেয়াটা বেপরোয়া একটা সিদ্ধান্ত…সরকার একটা নিরাপত্তা পরিকল্পনা ঘোষণা করেছে বলে সেখানে সহিংসতার মাত্রা বাড়াতে হবে, এটা ভাবাটা দায়িত্বজ্ঞানহীন। আফগান জনগণ স্পষ্টভাবে তাদের শান্তির আকাঙ্ক্ষা প্রকাশ করেছে”।

কিন্তু আলোচনার টেবিলে আটকে না থাকার জন্য খলিলজাদ তালেবানদের দায়ি করতে পারেন না। এই বন্ধ্যাত্বের পেছনে আসল কারণ হলো সেই শক্তিগুলো যারা সমঝোতার প্রচেষ্টা নষ্ট করতে চায় এবং যারা চুক্তির বিরোধী (কাবুল এবং তাদের একমাত্র সমর্থক নয়াদিল্লী) কারণ এই আলোচনায় তালেবানরা ক্ষমতায় ফিরে আসতে পারে।

২০১৯ সালের মার্চে যখন ‘খালিদ অপারেশানের’ ঘোষণা দেয়া হয়, উদ্দেশ্য তখনই পরিস্কার হয়ে গেছে। বর্তমান প্রতিরক্ষা মন্ত্রী (ও আফগান গোয়েন্দা সংস্থা, এনডিএসের সাবেক প্রধান) আসাদুল্লাহ খালিদের যে শ্লোগান ছিল – ‘আফগানিস্তান থেকে তালেবানদের পুরোপুরি বিলুপ্ত করা’ – সেই শ্লোগান অনুসারেই এই অভিযানের ঘোষণা দেয়া হয়েছে।

যদিও এই অভিযান মূলত কাবুলের একটা আগ্রাসী পরিকল্পনা এবং কাবুল যেহেতু শান্তি আলোচনার অংশ হয়ে ওঠেনি এখনও, কিন্তু তালেবানরা তাই বলে খলিলজাদ বা যুক্তরাষ্ট্রকে দোষারোপ করতে পারে না যে, তারা আফগান সরকারকে এই ধরনের অভিযানের ব্যাপারে উসকানি দিয়েছে। কাবুল আলোচনায় না থাকার অর্থ হলো তালেবানদের বিরুদ্ধে যুদ্ধের মাঠে রয়েছে, যেটাকে তারা ধূর্ততার সাথে ব্যবহার করেছে।

কিন্তু কাবুল আলোচনায় না থাকার পরিণতিতে যে যুদ্ধ শুরু হয়েছে, তার ফল হিসেবে আলোচনা থমকে গেছে, কাবুল আর নয়াদিল্লী এটাই চাচ্ছিল। এর আগেও এ ধরনের কথা বলেছি আমরা।

এর মানে হলো নতুন করে যুদ্ধের একটা মওসুম সামনে অপেক্ষা করছে এবং সে কারণেই খলিলজাদ/যুক্তরাষ্ট্র এবং পাকিস্তান এবং তালেবানরা চুক্তির দিকে যেতে পারবে না, যেটার মাধ্যমে তালেবানরা রাজনীতিতে ফিরে আসতে পারতো এবং যেমনটা আমরা জানি যে, এর মাধ্যমে বর্তমান রাজনৈতিক অভিজাতবর্গের রাজনৈতিক জীবনের ইতি ঘটবে, এবং যেটা আফগানিস্তানে নয়াদিল্লীর বহু ভূ-কৌশলগত স্বার্থের জন্য বড় ধরনের বিঘ্ন সৃষ্টি করবে।

ভারত সে অনুসারে দ্রুত যুক্তরাষ্ট্রের কাছে নিজেদের উদ্বেগের কথা জানিয়েছে যে, অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গঠনের মাধ্যমে আফগানিস্তানে ঘানি সরকারকে বদলে দেয়ার কোন সম্ভাবনা আছে কি না, পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী ইমরান খান সম্প্রতি যেটার কথা বলেছিলেন। ভারতীয় মিডিয়া রিপোর্ট প্রকাশ করেছে যে, ভারতের গোখলের সাথে বৈঠকে খলিলজাদকে বলা হয়েছে যে, ভারত সরকারের দৃষ্টিভঙ্গি হলো রাজনৈতিক কাঠামো যথাস্থানে থাকা উচিত এবং যুক্তরাষ্ট্র যখন সরে যাবে, তখন যেন আফগানিস্তানের একটি নির্বাচিত সরকার থাকে, কোন অন্তর্বর্তীকালীন প্রশাসন নয়, যারা সাংবিধানিকভাবে অনুমোদিত নয়”।

তবে, কাবুল আর নয়াদিল্লী যাই অর্জনের ইচ্ছা পোষণ করুক না কেন, তাদের জন্য সমস্যার একটা বড় কারণ হলো তারা আফগানিস্তানে এখনও কোন রাজনৈতিক ঐক্যমত অর্জন করতে পারেনি যে কিভাবে পরিস্থিতির অগ্রগতি হবে এবং তাদের নিজেদের গতি প্রকৃতিই বা কি হবে সেখানে।

পরিস্থিতি এমন দাঁড়িয়েছে যে, সরকারের প্রধান নির্বাহী এবং ঘানির বর্তমান জোট সরকারের অংশীদার এবং আসন্ন প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে তার প্রতিদ্বন্দ্বী আবদুল্লাহ আব্দুল্লাহ হাজার হাজার প্রবীণদের নিয়ে অনুষ্ঠিতব্য গ্র্যান্ড কাউন্সিল বয়কটের হুমকি দিয়েছেন। শান্তি পরিকল্পনা নিয়ে আলোচনার জন্য আগামী মাসে ঘানি এই কাউন্সিলের ডাক দিয়েছেন। আব্দুল্লাহ এবং ঘানির অন্যান্য প্রতিদ্বন্দ্বীরা মনে করছেন যে, এই প্ল্যাটফর্মকে ব্যবহার করে ঘানি তার নির্বাচনী প্রচারণা চালাতে পারেন এবং অন্যান্য প্রতিদ্বন্দ্বীর মাঝে নিজেকে দেশের নেতা হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করার চেষ্টা করতে পারেন।

এই সব কিছু মিলেই আলোচনা স্থবিরতার দিকে গেছে এবং ‘অনির্দিষ্টকালের জন্য’ সমঝোতা স্থগিত হয়ে গেছে – এই পরিস্থিতি সরাসরি সেই সব পক্ষের অনুকূলে গেছে যারা শান্তি প্রক্রিয়ার মাধ্যমে সমঝোতার প্রচেষ্টাকে ধ্বংস করে নিজেদের শাসন টিকিয়ে রাখতে চায়।

এতে আরও যেটা দেখা গেছে যে, ‘আফগানিস্তানের অভ্যন্তরীণ’ সংলাপের মন্ত্র ছিল শুধু একটা কথার কথা, যেটাকে ব্যবহার করে আলোচনাকে অবৈধ করার চেষ্টা করেছিল কাবুল। এই যখন অবস্থা, যখন তাদের দাবি পূরণ হতে যাচ্ছে, তখনই কাবুল চাকার মধ্যে লাঠি ঢুকিয়ে দিয়ে তালেবানদের বিরুদ্ধে ঠিক এমন সময় সামরিক অভিযানের ঘোষণা দিলো, যখন তালেবানরা প্রতি বছর তাদের বসন্তকালীন অভিযান শুরু করে। এ বছর তারা আলোচনা স্থগিত করার এবং অভিযান ঘোষণার বাড়তি আরেকটি কারণ পেয়ে গেলো।

এখন অন্তত কাবুল আর নয়াদিল্লী আরাম করতে পারে যে, কোন শান্তি চুক্তি এখনই হচ্ছে না এবং আরও এক বছর তারা যুদ্ধ দেখতে পারবে। কিন্তু বহু মিলিয়ন আফগানদের জন্য এটা ১৮তম বছরের যুদ্ধ। কিন্তু পরিস্থিতির উসকানীদাতারা এখন আগের চেয়েও বেশি সক্রিয় হয়ে উঠেছে।