অ্যাপস পেলেই ইনস্টল, চুরি যাচ্ছে সব তথ্য

অ্যাপস পেলেই ইনস্টল, চুরি যাচ্ছে সব তথ্য

প্রযুক্তি ডেস্ক: প্রতিদিন চুরি হয় ভার্চুয়াল জগতে বিচরণকারীদের ব্যক্তিগত নিরাপত্তা ও গোপন তথ্য। বিভিন্ন উপায়ে এসব তথ্য পেতে মুখিয়ে আছে বিশ্বের বড় বড় কোম্পানি। আর উন্নত বিশ্বের বিভিন্ন সংস্থা এসব তথ্য পেতে সাইবার দুনিয়ায় যে বিস্তীর্ণ জাল ফেলেছে, তা সবার জানা। এসব করা হয় বিভিন্ন অ্যাপসের মাধ্যমে। অনেক সময় না বুঝেই ব্যবহারকারীরা তাদের তথ্য তুলে দেয় জায়ান্ট কোম্পানিগুলোকে। পরে তারা এই তথ্য নিজেদের স্বার্থে কাজে লাগায়। এখন পর্যন্ত উন্নত দেশগুলোও এই তথ্য চুরি প্রতিরোধ করতে পারেনি সর্বোচ্চ চেষ্টা করেও।

বিটিআরসির সবশেষ তথ্যমতে, দেশে ১৬ কোটি ১৫ লাখ মোবাইল ফোন ব্যবহারকারীর মধ্যে ইন্টারনেট ব্যবহারকারী ১০ কোটি ২১ লাখ। এসব ব্যবহারকারীর ব্যক্তিগত তথ্য চুরির মাধ্যমে এক অর্থে দেশের চিত্রও জেনে যায় ওই সব কোম্পানি।

যেমন কিছুদিন ধরে ফেসবুকে লিবল্যাব নামে এক ফটোফিল্টার অ্যাপস নিয়ে বেশ মাতামাতি চলছে। এতে ছবি এডিট করে ফেসবুকে আপলোড করতে দেখা যায় অনেককে। এর আগে এসেছিল প্রিজমা অ্যাপস। আর টিকটক অ্যাপসটি নিয়ে বর্তমানে সারা বিশ্বে চলছে হৈ চৈ। তবে এসবের পেছনেও রয়েছে সেই তথ্য চুরি।

২০০৬ সালে জুলিয়ান অ্যাসেঞ্জ প্রতিষ্ঠা  করেছিলো ইউকিলিকস। একের পর এক বিশ্বের বিভিন্ন সরকারের সর্বোচ্চ গোপনীয় তথ্য প্রকাশ করতে থাকেন। তথ্য চুরির বিষয়টি তখন থেকেই প্রাধান্য পাচ্ছে সাইবার বিশেষজ্ঞদের কাছে।

২০১০ সালে জুলিয়ান অ্যাসাঞ্জ ইরাক ও আফগানিস্তানে মার্কিন সেনাবাহিনীর হাতে বেসামরিক নাগরিকদের নৃশংসভাবে হত্যার স্পর্শকাতর কয়েক লাখ গোপন তথ্যের নথি প্রকাশ করে। তখনই বিশ্ব গণ্যমাধ্যমে আলোচনার কেন্দ্রে চলে আসেন তিনি। যুক্তরাষ্ট্র তার বিরুদ্ধে মামলা করে এবং রায়ে তাকে কারাদণ্ড দেয়া হয়। যুক্তরাজ্যের লন্ডনে ইকুয়েডর দূতাবাসে ৮ বছর রাজনৈতিক আশ্রয়ে থাকার পর তার আশ্রয় বাতিল করে ইকুয়েডর। এখন লন্ডনের বেলমাস কারাগারে রয়েছে অ্যাসাঞ্জ। জামিনের শর্ত ভঙ্গ করার অভিযোগে তার বিচারও চলছে।

এদিকে ২০১৬ সালের মার্কিন প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে ট্রাম্পের প্রচার শিবিরের সঙ্গে রাশিয়ার আঁতাতের অভিযোগে মাঠে নামে ফেডারেল ব্যুরো অব ইভেস্টিগেশন (এফবিআই)। অ্যাটর্নি মুলারের নেতৃত্বে ২ বছর তদন্ত হয়। তদন্ত রিপোর্ট প্রকাশের পর ট্রাম্প নিজেকে নির্দোষ দাবি করে। তবে ২০১৯ সালের সেপ্টেম্বরে কংগ্রেসের স্পিকার আনুষ্ঠানিকভাবে অভিশংসনের জন্য তদন্ত শুরু করে।

এ বিষয়ে বিশেষজ্ঞরা বলছে, প্রিজমা বা লিবল্যাবসহ ফটোফিল্টারের মতো অ্যাপসগুলোর মাধ্যমে বড় বড় কোম্পানি হাতিয়ে নিচ্ছে এসব তথ্য। এভাবে তারা আসলে ব্যবহারকারীর জীবন বৃত্তান্ত থেকে রুচিবোধ পর্যন্ত জেনে যায়। তাই অ্যাপস পেলেই না বুঝে ইনস্টল করতে নেই।

বাংলাদেশ টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ কমিশনের (বিটিআরসি) সবশেষ তথ্যমতে, দেশে ১৬ কোটি ১৫ লাখ মোবাইল ফোন ব্যবহারকারীর মধ্যে ইন্টারনেট ব্যবহারকারীই ১০ কোটি ২১ লাখ। এই সোয়া ১০ কোটি মানুষের ব্যক্তিগত তথ্য চুরির মাধ্যমে তারা এক অর্থে দেশের চিত্রও জেনে যায়। এতে শুধু ব্যবহারকারীর ব্যক্তিগত নিরাপত্তা নয়, দেশের নিরাপত্তার বিষয়ও জড়িত।

এমনটাই বলছে- ভার্চুয়াল বিষয়ে দীর্ঘদিন কাজ করা বিশেষজ্ঞরা। তারা বলেছে, ব্যবহারকারীদের এ বিষয়ে সচেতন হতে হবে। এসব তথ্য দিয়ে অপরাধ কর্মকাণ্ডও হতে পারে।

এ বিষয়ে যুক্তরাজ্যের এআর ইন্টারন্যাশনাল সাইবার সিকিউরিটি ইনস্টিটিউটের স্টার আইটি ল্যাবের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা রিয়েল সাইবার ক্রাইমের বিষয়ে তার মতামত লিখেছে। বাংলাদেশ পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগের (সিআইডি) সাইবার পুলিশ বিভাগের ওয়েব সাইটে বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত এই সাইবার বিশেষজ্ঞ মন্তব্য করে, পৃথিবীতে জায়ান্ট কোম্পানিগুলো তাদের পণ্য বাজারে ছাড়ার আগে ট্রেন্ড ফলো করা লোকজনের ওপর জরিপ করে। কারণ প্রোডাক্টটি (পণ্য) দিয়ে সারাবিশ্বে ব্যবসা করতে চায় তারা। আপনার নিজস্ব রুচি জানাই এই কোম্পানিগুলোর কাছে প্রধান বিষয়। তারা আপনার রুচি অনুযায়ী পণ্য বানাতে চায়।

কোন কোন তথ্য চুরি হচ্ছে: আপনার ফেস এর কাঠামো (যা ডিভাইস ফেস আনলক করে) বা বায়োমেট্রিক তথ্য ব্যবহার করে তথ্য চুরি হচ্ছে। অ্যাকাউন্টে থাকা- জন্ম তারিখ, মেইল ও ফোন নাম্বার, রিলেশন স্ট্যাটাস ও এলাকা- এসব আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্ট ডাটা গ্রাবার (যা এপিআই দিয়ে ফেসবুকের সঙ্গে লিংক করা) দিয়ে হাতিয়ে নিচ্ছে ব্যক্তিগত সব তথ্য।

গুগল বা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে কোনো বিষয়ে সার্চ দিলে কিছুক্ষণ পরপরই সেই টপিকের কোনো স্পন্সরড লেখা পেজের বিজ্ঞাপন আসে। ক্লিক করলে ই-মেইলে অপরিচিত কন্টাক্টের মেইল আসে। এ সময় হয়তো কেউ তেমন ভাবেন না বা খেয়াল করে না যে- কেন হচ্ছে এসব?

রিয়েল লিখেছে- কারণটা খুবই সহজ। আপনি-আমিই আমাদের ডাটাগুলো ট্রেন্ডেরের চক্করে পড়ে তাদের হাতে তুলে দিচ্ছি। আমাদের সার্চ করা প্রতিটা কিওয়ার্ডই ডাটাবেজে সংরক্ষিত থাকে। পরবর্তীতে এগুলো মার্কেটিংয়ের কাজে লাগানো হয়। এই তথ্যগুলো সারফেস ওয়েবের বাইরে খোলাবাজারের মতো বিক্রি হয়। এছাড়া অনেক সময় এই তথ্য বিভিন্ন অপরাধকর্মে ব্যবহার করা হয়ে থাকে। তিনি সবাইকে এ বিষয়ে সচেতন থাকতে আহ্বান জানায়।

এসব বিষয়ে ১০ বছর ধরে কাজ করা স্টোনব্রিজ লিমিটেডের প্রধান আসাদ আল হোসেইনও রিয়েলের সঙ্গে একমত পোষণ করে। সে বলেছে, যদি কোনো অ্যাপস আপনার প্রয়োজন হয়, তবে গুগলের প্লে স্টোর থেকে নেয়া কিছুটা নিরাপদ। তবে জায়ান্ট কোম্পানি ও এসপিওনাজদের প্রতিরোধ করা যায়নি।

এ বিষয়ে সাইবার পুলিশের প্রধান পুলিশের উপ-মহাপরিদর্শক (ডিআইজিপি) মো. শাহআলমের সঙ্গে কথা হয়। তিনি ডেইলি বাংলাদেশকে বলেছে, বিষয়টি প্রাধান্য পাচ্ছে বলে আমি মনে করি না। তবে আমরা জাতীয় নিরাপত্তাসহ দেশের বিভিন্ন সাইবার অপরাপধ নিয়ে কাজ করছি।

এই গোয়েন্দা কর্মকর্তা আরো বলেছে, এটা পুরোপুরি একটা সিভিল ইস্যু। আমেরিকা, ব্রিটেনের মতো উন্নত দেশগুলোও এসব বিষয় সুরাহা করতে পারেনি। দেখা গেছে, এসব ক্ষেত্রে ব্যবহারকারী না বুঝেই অনেক সময় তথ্য তুলে দেয় তাদের হাতে। এসব অ্যাপস ব্যবহারের কিছু পূর্বশর্ত থাকে। ব্যবহারকারী না বুঝেই শর্তগুলোতে ইয়েস বা অ্যালাও করে। এভাবে ব্যবহারকারীর সব তথ্য জেনে নেয়া হয়। এমনকি এভাবে ব্যবহারকারীর মাইক্রোফোন পর্যন্ত কন্ট্রোল করা যায়। তিনি সবাইকে বুঝে-শুনে অ্যাপস ডাউন লোড করতে আহ্বান জানিয়েছে।