রোহিঙ্গা: দেশ ছেড়েছে ৯০ শতাংশ, এখনো আসছে
ডেস্ক: মিয়ানমার সেনাবাহিনী ও স্থানীয় বৌদ্ধ সন্ত্রাসীদের সম্মিলিত নিধন অভিযান থেকে প্রাণে বাঁচতে গত বছর থেকে বাংলাদেশে রোহিঙ্গাদের ঢল শুরু হয়েছিলো। তা এখনও অব্যাহত আছে। আন্তর্জাতিক জনমতের চাপে পড়ে মিয়ানমার রোহিঙ্গাদের ফিরিয়ে নিতে গত নভেম্বরে প্রত্যাবাসন চুক্তিতে সই করে।
প্রত্যাবাসন চুক্তির পরও রোহিঙ্গাদের বাংলাদেশে আসা থামছে না। গত শনিবারও সীমান্ত পাড়ি দিয়ে ২২টি রোহিঙ্গা পরিবারের ৮২ জন বাংলাদেশে ঢুকেছে।
জাতিসংঘের শরণার্থীবিষয়ক সমন্বয়কারী সংস্থা ও রাখাইনের স্থানীয় প্রশাসনের দেয়া তথ্যের ভিত্তিতে মিয়ানমারের প্রভাবশালী ইংরেজি দৈনিক ‘দ্য ইরাবতি’ গত শনিবার জানিয়েছে, রাখাইনে বসবাসরত তিনটি শহরের ( মংডু, বুথিডং ও রাথেডং) রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর অন্তত ৯০ শতাংশকে দেশত্যাগে বাধ্য করেছে বৌদ্ধ সেনাবাহিনী।
২৫ আগস্টের পর ওই অঞ্চলে মিয়ানমার সেনাবাহিনী জুলুম-নির্যাতন জোরদার করলে ৬ লাখ ৮৮ হাজার রোহিঙ্গা বাংলাদেশে আশ্রয় নিয়েছে। এখন রাখাইনের তিনটি শহরে অবস্থানরত রোহিঙ্গার সংখ্যা কয়েক হাজার মাত্র। সরকারি ও আন্তর্জাতিক এনজিও সংস্থাগুলোর পরিসংখ্যান পর্যালোচনা করে এ তথ্য প্রকাশ করেছে সংবাদমাধ্যমটি।
ইরাবতি উদ্বাস্তু হওয়া রোহিঙ্গাদের সংখ্যা বের করতে রাখাইনের তিনটি শহরের সরকারি প্রতিবেদন সংগ্রহ করে করেছে। ওই প্রতিবেদন তৈরি করেছে রাখাইনের জেনারেল অ্যাডমিনিস্ট্রেটিভ ডিপার্টমেন্ট (জিএডি)।
এটি মিয়ানমারের সেনাবাহিনীর নিয়ন্ত্রণাধীন স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের আওতাধীন একটি প্রতিষ্ঠান। জিএডির প্রতিবেদন ২০১৭ সালের অক্টোবরে প্রকাশিত হয়েছে। সংবাদমাধ্যমটি জিএডির প্রতিবেদন থেকে প্রাপ্ত পরিসংখ্যান বাংলাদেশের রোহিঙ্গা শিবিরের জাতিসংঘের মানবিক সহযোগিতাবিষয়ক সংস্থা ওসিএএইচএর তথ্যের সঙ্গে মিলিয়ে পর্যালোচনা করেছে।
ওসিএইচএর তথ্যমতে, ২৫ আগস্ট থেকে ২৭ জানুয়ারি পর্যন্ত ৬ লাখ ৮৮ হাজার আসা রোহিঙ্গাকে বাংলাদেশে নিবন্ধিত করা হয়েছে।
জিএডির প্রতিবেদন অনুযায়ী, বৌদ্ধ সেনাবাহিনীর নিপীড়ন শুরুর আগে মংডু, বুথিডং ও রাথিডংয়ে ৭ লাখ ৬৭ হাজারের বেশি রোহিঙ্গা বাস করত। মংডুর একজন সরকারি কর্মকর্তা নিশ্চিত করেন, এই পরিসংখ্যান ২০১৬ সালে সংগ্রহ করা।
এ তথ্যের সঙ্গে ওসিএইচএর আশ্রয়শিবিরে নিবন্ধনের তথ্য পর্যালোচনা করে বলা হয়, ওই সব এলাকা থেকে প্রায় ৯০ শতাংশ রোহিঙ্গাকেই দেশত্যাগে বাধ্য করা হয়েছে। মাত্র ১০ শতাংশ এখনও সেখানে রয়েছে। তবে এই ৯০ শতাংশের মধ্যে যারা মারা গেছেন, নিখোঁজ হয়েছেন বা গ্রেফতার হয়েছে তাদের ধরা হয়নি।
পরিসংখ্যান পর্যালোচনায় উঠে এসেছে, আক্রান্ত এলাকাগুলো থেকে যে ১০ শতাংশ রোহিঙ্গা বাংলাদেশে আসেননি, তাদের সংখ্যা ৭৯ হাজারের মতো। ফলে বাকি প্রায় ৭ লাখ ৬৭ হাজারকেই জোর করে তাড়িয়ে দেয়া হয়।
জিএডির প্রতিবেদনে জানানো হয়েছে, রাথিডংয়ের ৬ শতাংশ, বুথিডংয়ের ৮৪ শতাংশ ও মংডুর ৯৩ শতাংশ জনসংখ্যাই ছিল রোহিঙ্গা। প্রতিবেদনে অবশ্য তাদের ‘রাহিঙ্গা’ বলে উল্লেখ করা হয়নি। ওই প্রতিবেদনে তাদের ‘বাংলাদেশি’ লেখা হয়েছে।
জিএডির প্রতিবেদনে স্পষ্ট করে উল্লেথ করা হয়নি- প্রতিটি শহরে রোহিঙ্গা ও আরাকান (রাখাইন) জাতিগোষ্ঠীর কতটি গ্রাম রয়েছে। এতে শুধু মোট গ্রামের সংখ্যা উল্লেখ করা হয়।
মংডু ও বুথিডংয়ের জিএডি কর্মকর্তাদের মতে, মংডুর ৩৬৪টি গ্রামের মধ্যে ২৭২টি রোহিঙ্গাদের, যা ওই এলাকার মোট গ্রামের ৭৪ শতাংশ। বৌদ্ধ সেনাবাহিনীর নির্মূল অভিযানে নিরাপত্তা বাহিনীর সদস্যরা শতাধিক গ্রাম পুড়িয়ে দিয়েছে।
বুথিডংয়ের ৩৩৯টি গ্রামের মধ্যে ১৩৭টিই রোহিঙ্গাদের, যা শহরটির মোট গ্রামের ৫১ শতাংশ। শহরটির এক উচ্চপদস্থ জিএডি কর্মকর্তা জানান, এখানকার অন্তত ৩০টি গ্রাম পুড়িয়ে ছাই করে দেয়া হয়েছে।
রাথিডংয়ে আগস্টের সহিংসতা শুরুর আগে সেখানে ২২টি রোহিঙ্গা গ্রাম ছিল। রোহিঙ্গাদের কাছ থেকে জানা যায়, সেখানে এখন মাত্র দু-তিনটি গ্রাম টিকে আছে। বাকিগুলো পুড়িয়ে দেয়া হয়েছে।
এদিকে, প্রত্যাবাসন নিয়ে বাংলাদেশ ও মিয়ানমারে তোড়জোড়ের মধ্যেই দেখা যাচ্ছে, এখনও প্রতি সপ্তাহে বাংলাদেশে শতাধিক রোহিঙ্গা আসছেন। আগের মতো বিশাল সংখ্যায় রোহিঙ্গাদের ঢল না নামলেও এখনও প্রতি সপ্তাহেই এ জনগোষ্ঠীর সদস্যরা নাফ নদ পাড়ি দিয়ে প্রবেশ করে চলেছেন। তারা রাখাইনে নিজেদের বাড়িতে নিরাপদ বোধ করেন না। সেখানে তাদের হয়রানির শিকার হতে হয়।