এক ধানগাছ থেকে ফলন পাঁচবার!
- প্রথমবার চাষে ১১০ দিন পর ফলন আসে
- পরের ফলন আসে ৪৫ দিন অন্তর
- একবার বোরো
- দুবার আউশ
- দুবার আমন ধান আসে
মৌলভীবাজার সংবাদাদাতা: ধানের এ নতুন জাত উদ্ভাবন করেছেন জিনবিজ্ঞানী ড. আবেদ চৌধুরী। প্রবাসী এ বিজ্ঞানী দীর্ঘদিন ধরে ধানের নতুন জাত আবিষ্কার নিয়ে গবেষণা চালিয়ে আসছেন। এক ধান গাছ থেকে পাঁচবার ফলন পাওয়ায় তিনি সন্তুষ্ট নন। কারণ, একই গাছ থেকে যেন ছয়বার ধান পাওয়া যায়, বর্তমানে তা নিয়ে গবেষণা করছেন। একই সঙ্গে নতুন জাতের এ ধান যাতে সারাদেশে চাষাবাদ করা যায়, সেই চেষ্টা চালাচ্ছেন।
মৌলভীবাজারের কুলাউড়া উপজেলার হাজীপুর ইউনিয়নের কানিহাটি গ্রামে এখন দিগন্ত জোড়ানো ফসলের মাঠ। এই গ্রামের সন্তান জিনবিজ্ঞানী ড. আবেদ চৌধুরী। তার উদ্ভাবন করা নতুন এই জাত এবার চাষ হয়েছে নিজ গ্রামেই। অবিশ্বাস্যভাবেই এই ধান একবার রোপণের পর পাঁচবার কাটা যায়। বছরে এই একই ধানগাছ থেকে সর্বোচ্চ পাঁচবার ফসল পাওয়া যায়। যা নিয়ে কৃষকদের মাঝে চলছে আলোচনা।
সরেজমিনে কুলাউড়ার কানিহাটি গ্রামে দেখা যায়, গ্রামজুড়ে বিস্তীর্ণ সোনালি ফসলের মাঠ। এই ফসলের মধ্যে জন্মেছে নতুন এই ইতিহাস সৃষ্টিকারী ধান। এই ধান একবার রোপণে বছরজুড়ে পাঁচবার ফলন এসেছে।
তবে শুরুটা কীভাবে হয়েছে, সে বিষয়ে তিনি বলেন, আমার কৃষির ওপরে খুব নির্ভরশীল ছিলাম। আমি দেখেছি যারা ধান চাষ করেন, তারা উন্নত জীবন যাপন করতে পারেন না। এটা আমার জন্য খুব পীড়াদায়ক ছিল। কারণ, আমরা কৃষিনির্ভর পরিবারের মানুষদের দেখিছি দেশে খুব অবহেলিত। মানুষ শুধু চায় কম দামে ধান পেতে। কিন্তু কৃষকরা যে মূল্য পাচ্ছেন না, সেটা নিয়ে কারও কোনো মাথাব্যথা নেই।
তিনি বলেন, কৃষিতে কীভাবে আয় বাড়ানো যায়, ব্যয় কমানো যায়, এটা নিয়ে আমি সারাক্ষণ চিন্তা করি। আমার চিন্তা হলো একটা ধান জমিতে থাকবে, বিশাল আকার ধারণ করে অনেক ধান দেবে। এ জিনিসটাই করতে চেয়েছি এতদিন। অত্যন্ত আনন্দের বিষয়, আমি তা করতে পেরেছি। বোরো হিসেবে বছরের প্রথমে লাগানো এই ধান ১১০ দিন পর পেকেছে। ওই গাছেই পর্যায়ক্রমে ৪৫ দিন পরপর একবার বোরো, দুবার আউশ এবং দুবার আমন ধান পেকেছে। কম সময়ে পাকা এই ধানের উৎপাদন বেশি, খরচও কম। তবে প্রথম ফলনের চেয়ে পরের ফলনগুলোয় উৎপাদন কিছুটা কম। কিন্তু পাঁচবারের ফলন মিলিয়ে উৎপাদন প্রায় পাঁচ গুণ বেশি।
আবেদ চৌধুরী জানান, যে জাতগুলোর ধান পাকার পর কেটে নিয়ে গেলে আবার ধানের শিষ বের হয়, সেগুলো তিনি আলাদা করেন। এভাবে ১২টি জাত বের করেন। তিন বছর ধরে জাতগুলো চাষ করে দেখলেন, নিয়মিতভাবে এগুলো দ্বিতীয়বার ফলন দিচ্ছে। তারপর তিনি শুরু করেন একই গাছে তৃতীয়বার ফলনের গবেষণা। চারটি জাত একই গাছ থেকে পাঁচবার ফলন দিচ্ছে। এ চারটি জাতের ওপর ১০ বছর ধরে চলছে গবেষণা।
চলতি বছরের জানুয়ারিতে বোরো ধানের এ চারটি জাত দুই বিঘা জমিতে রোপণ করা হয়। পরিমাণমতো ইউরিয়া সার প্রয়োগ করা হয়। সঠিকভাবে সেচ ও পরিচর্যা করার পর ১১০ দিনের মধ্যে ৮৫ সেন্টিমিটার থেকে এক মিটার উচ্চতার গাছে ফসল আসে। পরে মাটি থেকে ৩৫ সেন্টিমিটার উচ্চতায় পরিকল্পিতভাবে ওই ধান কেটে ফেলা হয়।
মে মাসের প্রথম দিকে প্রথমবার কাটা ধানে হেক্টরপ্রতি উৎপাদন হয়েছে চার টন। তারপর থেকে ৪৫ দিন অন্তর প্রতিটি মৌসুমে হেক্টরপ্রতি কখনো দুই টন, কখনো তিন টন ফলন এসেছে। সবগুলো জাত হেক্টরপ্রতি প্রায় ১৬ টন ফলন দিয়েছে। যেহেতু পাঁচবার চাষ হয় সেহেতু নাম দিয়েছি ‘পঞ্চব্রীহি’ নাম দি
তে চাই। এখনো কনফার্ম হয়নি। চাইছি আমার এলাকার নামেও দিতে।
তিনি বলেন, বছরের যেকোনো সময়ে এ ধান রোপণ করা যায়। এখন পরের ধাপগুলোতে কিছুটা কম উৎপাদন হচ্ছে। আমার চেষ্টা থাকবে, আরও বেশি ফলন বের করার। এ ধানের বীজ সংগ্রহ সহজ। কৃষকরা নিজেরাই তা করতে পারবেন। অন্য ধানের মতো বীজতলায় রোপণের পর চারা তুলে চাষ করতে হয়।
পঞ্চমবার ফলন দেওয়া ধান উদ্ভাবন সম্পর্কে বিস্তারিত তুলে ধরে আবেদ চৌধুরী বলেন, এর আগে আমি অন্য ধানের জাত উদ্ভাবন করেছি। দুবার ফসল হয়, এমন ধানও উদ্ভাবন করেছিলাম; যাকে আন্তর্জাতিক মিডিয়া ‘রাইস টুআইস’ বলেছে। আবার অনেকে ‘জীবন বর্ধিত ধান’ বলেছে। এই প্রথম সারা বছর ধরে আমার অন্য আরেকটি ধানের জাত মাঠে থাকল। এ ধানের চারা ৫ সেন্টিমিটার দূরত্বে রোপণ করতে হয়। ফলে গাছটি মাটি থেকে ভালোভাবে শক্তি নিয়ে বেড়ে উঠতে পারে এবং একটি ধান গাছ থেকে আরও বেশ কয়েকটি ধান গাছ গজাতে থাকে।
আবেদ চৌধুরীর এই ধান দেখাশোনা করছেন রাসেল মিয়া। তিনি বলেন, কৃষকরা খুব কম খরচে এই ধান উৎপাদন করতে পারবেন। প্রথমবার উৎপাদনে যে খরচ হয়, পরের বার আর তেমন খরচ নেই। প্রথমবার জমি প্রস্তুত করে বোরো রোপণের পর আর জমিতে হাত দিতে হয় না। নির্দিষ্ট একটা ব্যবধানে ধান কেটে নেওয়ার পর মোড়ায় ঘাস বাছাই করে সার দিই। তারপর আবার ধানের গাছ বাড়তে থাকে এখান থেকে।
রাসেল আরও জানান, পোকামাকড়ে ধরলে সামান্য কীটনাশক ব্যবহার করতে হয়। রোদ-বৃষ্টিতে এই ধান নষ্ট হয় না। ধানের গাছও খুব শক্ত থাকে। স্থানীয় কৃষকরা এ ধানের জন্য অপেক্ষা করছেন। তারা ধানের ফলন দেখে আগ্রহী হয়েছেন চাষাবাদ করতে।
কানিহাটি গ্রামের কৃষক রুশন মিয়া বলেন, আমাদের এলাকার ড. আবেদ স্যার যে ধান উৎপাদন করেছেন, সেটা আমাদের জন্য গর্বের বিষয়। আমরা এই ধান নিজেরা চাষ করার জন্য অপেক্ষায় আছি।
মৌলভীবাজারের কুলাউড়া উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা আব্দুল মোমিন বলেন, এক গাছে পাঁচবার ধান উৎপাদন নতুন দেখেছি। এটি দেশের জন্য সুখবর। যদিও এখনো সরকার এটা নিয়ে এখনো কিছু বলেনি। তবে এই উদ্ভাবনের রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি পাওয়া উচিত।
ড. আবেদ চৌধুরী বংশগতিবিষয়ক গবেষক। অস্ট্রেলীয় একদল বিজ্ঞানীর সঙ্গে তিনি ফিস (ইনডিপেনডেন্ট সিড) জিন আবিষ্কার করেন। তিনি লাল রঙের চাল ও রঙিন ভুট্টা উদ্ভাবন করেছেন। তার রঙিন ভুট্টা ডায়াবেটিস ও ক্যানসার প্রতিরোধক হিসেবে বিশ্বব্যাপী আলোচিত। এখন তিনি অস্ট্রেলিয়ায় উচ্চফলনশীল ধান উৎপাদন ও ভবিষ্যতের খাদ্য নিরাপত্তাবিষয়ক গবেষণা করছেন।
কুলাউড়ার কানিহাটি গ্রামের কৃতী সন্তান আবেদ চৌধুরী যুক্তরাষ্ট্রে কৃষি বিষয়ে উচ্চশিক্ষা শেষে চাকরি নিয়ে চলে যান অস্ট্রেলিয়ায়। সেখানকার জাতীয় গবেষণা সংস্থার প্রধান ধানবিজ্ঞানী হিসেবে ধানের জিন নিয়ে গবেষণা করে কাটিয়ে দিয়েছেন ২০ বছর। এ পর্যন্ত তিনি প্রায় ৩০০ রকমের নতুন ধান উদ্ভাবন করেছেন। পেশাগত কারণে বিদেশের মাটিতে গবেষণা করলেও দেশে তার গ্রাম কানিহাটিতে গড়ে তুলেছেন খামার। তার নামে আবেদ ধানও এলাকায় চাষ করে ব্যাপক সফল হয়েছেন কৃষকরা।